ন্যাচারোপ্যাথি, পাতা

সজনে ও সজনে গাছের বহুবিধ উপকারিতা ও গুনাগুণ

সজনে বা সজনা বা সাজিনা (বৈজ্ঞানিক নাম: Moringa oleifera হচ্ছে মোরাসি পরিবারের মোরিঙ্গা গণের একটি বৃক্ষ জাতীয় গাছ। বাংলাদেশ ও ভারতে একটি বহুল পরিচিত বৃক্ষ, যার কাঁচা লম্বা ফল সবজি হিসেবে খাওয়া হয়, পাতা খাওয়া হয় শাক হিসেবে। সজনা গাছের কাঠ অত্যন্ত নরম, বাকলা আঠাযুক্ত ও কর্কি। সজিনা তিন প্রকারের হয়ে থাকে; নীল, শ্বেত ও রক্ত সজিনা। সজনে গাছ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন:
সজনে গাছের রয়েছে নানাবিধ গুনাগুণ যা নিম্নে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো।


(১) সজনের পাতা: শাকের মতো রান্না করে (কিন্তু ভাজা নয়) আহারের সময় অল্প পরিমাণে খেলে অগ্নিবল বৃদ্ধি হয় ও আহারে প্রবৃত্তি নিয়ে আসে; তবে পেট রোগাদের-ঝোল ক’রে অল্প খাওয়া ভাল। তবে হ্যাঁ, এটা গরীবের খাদ্যই বটে, কারণ তার মধ্যে আছে ভিটামিন এ, বি, সি, নিকোটিনিক এসিড, প্রোটিন চর্বিজাতীয় পদার্থ, কার্বোহাইড্রেট এবং শরীরের পোষণ-উপযোগী আরও প্রয়োজনীয় উপাযোগী আরও প্রয়োজনীয় উপাদান; এসব তথ্য কিন্তু নব্য বৈজ্ঞানিকের সমীক্ষার। এই শাক কোল, ভীল, মণ্ডা প্রভৃতি আদিবাসিদের নিত্য প্রিয় ভোজ্য শাক। তারা কিন্তু গণ জেনে খাচ্ছে না আদিকালের সংস্কারেই খায়।

(২) সজনের ফুল: শাকের মতো রান্না করে বসন্তকালে খাওয়া ভাল। এটা একটা বসন্ত-প্রতিষেধক দ্রব্য। তবে ইউনানি চিকিৎসক সম্প্রদায় ফল (শুক) ব্যবহার করেন সর্দি কাসির দোষে, শোথে, প্লীহা ও যকৃতের (Liver) কার্যকারিত্ব শক্তি কমে গেলে, ক্রিমির আধিক্য থাকলে এবং টনিকের একটি অন্যতম উপাদান হিসাবে

(৩) সজনের ফল (ডাটা): ‘ধুকড়ির মধ্যে খাসা চালের’ মতো আমাদের দেশে সজনের ডাঁটা। নব্য বৈজ্ঞানিকের বিশ্লেষণ বিচারে পাতা ও ফল (ডাটা) অধিক সমগুণের অধিকারী হলেও ডাঁটাগুলি Amino acid সমৃদ্ধি, যেটা দেহের সাময়িক প্রয়োজন মেটায়। সর্বক্ষেত্রে সব দ্রব্যেরই ব্যবহার করা উচিত পরিমিত ও সীমিত। ইউনানি চিকিৎসকগণের মতে বাতব্যাধি রোগগ্রস্ত ব্যক্তিদের ও যারা শিরাগত বাতে কাতর, তাঁদের আহার্যের সঙ্গে এটি ব্যবহার করা ভালো।

(৪) বীজের তেল: এদেশে সজনের বীজের তেলের ব্যবহার হয় না, তাই পরীক্ষাও তেমন হয়নি, তবে আমাদের এ দেশের বীজের তেমন তেল পাওয়া যায় না, আমদানী হয় আফ্রিকা থেকে নাম তার ‘বেন অয়েল’। ঘড়ি মেরামতের কাজে লাগে, বাতের ব্যথায়ও মালিশে নাকি ভাল কাজ হয়। এ ভিন্ন গাছের ও মূলের (ত্বক) গণের অন্ত নেই। এই গাছের গুণের কথায় অষ্টাদশ পর্ব মহাভারত রচিত হয়।

সজনের শাক হিসেবে ব্যবহৃত পাতা ভিটামিন এ–এর এক বিশাল উৎস। সজনের পাতা এবং ফল উভয়ের মধ্যেই বিপুল পরিমাণে পুষ্টি আছে। এতসব পুষ্টিগুণ একসাথে আছে বলেই এর মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং জীবন ধারনের পুষ্টি দুটোই পাওয়া যায়। আফ্রিকায় সজনে সাফল্যের পেছনে এটাই মূল কারণ। দুয়েকটি নির্দিষ্ট ভিটামিন বা মিনারেল নয়; বরং বহু ধরনের ভিটামিন, মিনারেল, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফ্যাটের সমাহার এই সজনে।

সজিনা পাতা শাকের মতো রান্না করে আহারের সময় অল্প পরিমাণে খেলে বল বৃদ্ধি পায় ও ক্ষুধা বাড়ে। পাতা কেটে ফোঁড়া বা টিউমারে দিলে উপকার পাওয়া যায়। উত্তরবঙ্গে সজিনা পাতাকে শাক হিসেবে খাওয়া হয়। এতে তাদের শ্রমজনিত ক্লান্তি, শরীরের ব্যথা ইত্যাদি দূর হয়।

সজিনা ফুল শাকের মতো রান্না করে বসন্তকালে খেলে বসন্তের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ হয়। এছাড়া সর্দি, কাশিতে, শোথে, প্লীহা ও যকৃতের কার্যকারিতা কমে গেলে এবং কৃমিনাশক হিসেবে সজিনা ব্যবহার করা যায়।

সজনার বিভিন্ন উপকারিতা
বিজ্ঞানীদের মতে, সজিনা ডাঁটা অ্যামাইনো এসিড সমৃদ্ধ, যা দেহের পাশাপাশি বাতের জন্যও খুব উপকারী। সজিনা বীজের তেল আমাদের দেশে তেমন পাওয়া যায় না। একে ‘বেন অয়েল‘ বলে। এটি ঘড়ি মেরামতের কাজে লাগে। বাতের ব্যথায় তা ভালো কাজ দেয়। কুষ্ঠ রোগে বীজের তেল অথবা বীজের তেলের অভাবে বীজ বেটে প্রলেপ দিলে উপকার হয়। সজিনা মূল ও বীজ সাপে কামড়ানোর চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া মূলের ছালের প্রলেপে দাদ উপশম হয়। বাংলাদেশে এ নিয়ে তেমন গবেষণা না হলেও বিশ্বের বহু দেশে নানা রকমের গবেষণা হয়েছে; বিশেষ করে এ গাছ হরমোন বর্ধক ঔষধি গুণসম্পন্ন, কাগজ তৈরি ইত্যাদি বিষয় ছাড়াও প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের দেশে এটি সবজির পাশাপাশি ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। দেশের সর্বত্রই সাজনা পাওয়া যায়। বিশেষ করে গ্রামের রাস্তার ধারে এবং বসতবাড়ির আঙিনায় যত্ন ছাড়াই বেড়ে ওঠে এ বৃক্ষটি। সাজনার ফুল ও পাতা শুধু শাক হিসেবেই নয়, পশু খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার হয়। এর পাতা শাক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এতে শারীরিক শক্তি ও আহারের রুচিবর্ধক হয়। এর মধ্যে আছে ভিটামিন এ, বি, সি, নিকোটিনিক এসিড, প্রোটিন ও চর্বি জাতীয় পদার্থ, কার্বোহাইড্রেট ইত্যাদি। ভারতীয়রা এটির স্যুপ খেয়ে থাকে। এ সময় ঋতু পরিবর্তনের কারণে আমাদের অনেকেরই মুখে স্বাদ থাকে না। আর এ স্বাদকে ফিরিয়ে আনতে সাজনার জুড়ি নেই। সজিনা গাছটির প্রতি আমাদের তেমন আগ্রহ না থাকলেও এর ডাঁটা সব মানুষই পছন্দ করে। আমরা জানি, সবজি মাত্রই পুষ্টিকর খাদ্য। তবে সাজনা শুধু পুষ্টিকর সবজি নয় এটি ওষুধি বৃক্ষও বটে।

সাজনার ফুল বসন্তকালে খাওয়া ভালো কারণ এটি বসন্ত প্রতিষেধক। এটি সর্দি কাশিতে, যকৃতের কার্যকারিতায়, কৃমি প্রতিরোধে, শক্তি বৃদ্ধিতে ফলদায়ক। এর ডাঁটা বা ফলে প্রচুর এমাইনো এসিড আছে। এটি বাত রোগীদের জন্য ভালো। সাজনার বীজ থেকে তেলও পাওয়া যায়, যা বাতের ওষুধ তৈরির কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে এবং ঘড়ি ঠিক করার জন্য যে বেল ওয়েল ব্যবহার হয় তা এর বীজ হতে পাওয়া যায়।

সজিনার পাতা বেটে ফোঁড়া বা টিউমারে লাগালে বহু ক্ষেত্রে মিলিয়ে যায় এবং ফোলা ও ব্যথার উপশম হয়। স্বাদে ও গুণে ভরপুর সজিনা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদন করা লাভজনক। কারণ অন্যান্য সবজির মতো এর উৎপাদনে তেমন ঝুঁকি নেই এবং লাভজনক।

ভেষজ ও অন্যান্য ব্যবহার:
ভেষজ বা ঔষধি গুণ। সারা দুনিয়ার বিভিন্ন জাতির লোকজন শত উপায়ে সজনে গাছকে কাজে লাগায়। গৃহপালিত পশু ইহার পাতা খেয়ে থাকে বিশেষ করে ছাগল, উট এবং গাধা। সুদানে পানি বিশুদ্ধ করতে বহুকাল ধরে সমগ্র উদ্ভিদ অথবা ইহার বীজ চূর্ণ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ইহার বীজে কার্যকরী ব্যাকটেরিয়া নাশক ও ছত্রাক নাশক আইসোথিয়োসায়ানেট বিদ্যমান। বীজ তেল বিন তেল নামে পরিচিত এবং ইহা রান্নার কাজে, কেশতেল হিসেবে, লুব্রিকেন্ট হিসেবে এবং পারফিউম শিল্পে ব্যবহৃত হতে পারে। বীজে শতকরা ৩৬-৪২ ভাগ তেল বিদ্যমান যার শতকরা ৬৫-৭৫ ভাগ ওলেয়িক এসিড। কচি পাতা স্কার্ভী এবং সর্দি জনিত রোগে ব্যবহৃত হয়, ক্ষত, আগুনে পোড়া এবং ফোলায় পট্টি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কান্ডের বাকল তিক্ত স্বাদবিশিষ্ট, বলবর্ধক, মূত্রবর্ধক এবং স্কার্ভী রোগ প্রতিরোধক, হৃৎপিণ্ডের বলকারক ঔষধ হিসেবে, হাঁপানী এবং কাশিতে ব্যবহৃত হয়। শিকড়ের বাকল তিক্ত, বলবর্ধক এবং মূত্রবর্ধক। তরুণ বৃক্ষের টাটকা শিকড় সবিরাম জ্বরে, মৃগীরোগে, মূর্ছারোগে, পুরনো বাতরোগে, গেঁটে বাত, উদরীরোগ, অজীর্ণতা এবং যকৃৎ ও প্লীহা বৃদ্ধিতে প্রয়োগ করা হয়। দুধের সাথে ফুটানো পুষ্প পুরুষদের যৌনশক্তি বৃদ্ধিকারক। কচি ফল ক্ষুদ্রান্ত্রের কৃমিনাশক, বীজ, তেল এবং আঠাতেও ভেষজ গুণাবলী বিদ্যমান (Dastur, 1962).

নিম্নে প্রতি ১০০ গ্রাম খাওয়ার উপযোগী সবুজ পাতা এবং কাঁচা ফলের পুষ্টির উপাদান এবং তার পরিমাণ উল্লেখ করা হলো (Bosch, 2004)

পুষ্টি উপাদান সবুজ পাতা সবুজ ফল
কার্বোহাইড্রেট ৮.৩ গ্রাম ৮.৫ গ্রাম
প্রোটিন ৯.৪ গ্রাম ২.১ গ্রাম
ফ্যাট ১.৪ গ্রাম ০.২ গ্রাম
ক্যালসিয়াম ১৮৫ মিলি ৩০ মিলি
ম্যাগনেসিয়াম ১৪৭ মিলি ৪৫ মিলি
ফসফরাস ১১২ মিলি ৫০ মিলি
আয়রন ৪ মিলি ০.৪ মিলি
জিঙ্ক ০.৬ মিলি ০.৪ মিলি
এ্যাস্কর্বিক এসিড ৫১.৭ মিলি ১৪১ মিলি
থায়ামিন ০.৩ মিলি ০.০৫ মিলি
রিবোফ্লাভিন ০.৭ মিলি ০.০৭ মিলি
নিয়াসিন ২.২ মিলি ০.৬ মিলি
ভিটামিন এ ৭৫৬৪ আইইউ ৭৪ আই ইউ

ভেষজ চিকিৎসায় সজনে গাছের মূল, ছাল, পাতা, ফুল ও ফল, বীজ এবং কষ ব্যবহার করা হয়। নিম্নে ভেষজ শাস্ত্রে বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে সজনের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে উল্লেখ করা হলো।

১. হাই ব্লাড প্রেসার (High Blood Pressure): নাফেন সংবাদ প্রতিষ্ঠানের একটি সংবাদ প্রকাশ বার্মিজ চিকিৎসকগণের মতে-সজনের পাকা পাতার টাটকা রস (জলে বেটে নিংড়ে নিতে হবে)। দুইবেলা আহারের ঠিক অব্যবহিত পূর্বে ২ বা ৩ চা-চামচ করে খেলে সপ্তাহের মধ্যে প্রেসার কমে যায়। তবে যাদের প্রস্রাবে বা রক্তে সুগার আছে, সেক্ষেত্রে এটা খাওয়া নিষেধ করেছেন। এটির সত্যাসত্য বৈজ্ঞানিকগণকে দেখতে অনুরোধ করি।

২. অর্বুদ রোগ (Tumour): ফোঁড়ার প্রথমাবস্থায় গ্রন্থিস্ফীতিতে (Glandular swelling) অথবা আঘাতজনিত ব্যথা ও ফোলায়-পাতা বেটে অল্প গরম করে লাগালে ফোঁড়া বা টিউমার বহুক্ষেত্রে মিলিয়ে যায় এবং ব্যথা ও ফোলার উপশম হয়।

৩. সাময়িক জ্বর বা জ্বরভাব: এর সঙ্গে সর্দির প্রাবল্য থাকলে অল্প দু’টো পাতা ঝোল করে বা শাক রান্না করে খেলে উপশম হয়।

৪. হিক্কায় (Hiccup): হিক্কা হতে থাকলে পাতার রস ২ থেকে ৫ ফোটা করে দুধের সঙ্গে ২/৩ বার খেতে দিলে কমে যায়।

৫. অর্শে (Piles): অর্শের যন্ত্রণা আছে, অথচ রক্ত পড়ে না এক্ষেত্রে নিমাগে লি তৈল লাগিয়ে পাতা-সিদ্ধ কাথ দ্বারা সিক্ত করতে বলেছেন চরক।

৬. সন্নিপাত জন্য চোখে ব্যথা, জল বা পিচুটি: এসব ক্ষেত্রে পাতা-সিদ্ধ জল সেচন করতে বলেছেন বাগভট।

৭. দাঁতের মাড়ি ফোলায়: শ্লেমাঘটিত কারণে দাঁতের মাড়ি ফুলে গেলে পাতার ক্বাথ মুখে ধারণ করলে উপশম হয়।

৮. কুষ্ঠ (Leprosy): কুষ্ঠের প্রথম অবস্থায় বীজের তৈল ব্যবহার করতে পারলে ভাল হয়। বীজ বেটে কুষ্ঠের ক্ষতের উপর প্রলেপ দিলেও চলে (এটি সুশ্রুতের অভিমত)।

৯. অপচী রোগে (Scrofula): সজনে বীজ চূর্ণ করে নস্য নিতে হয়। এটি সুশ্রুতের ব্যবস্থা।

০. দাদে (Ring worm): সজনে মূলের ছালের প্রলেপে এটার উপশম হয়। তবে এটা প্রত্যহ ব্যবহার করা ঠিক নয়।

আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ১, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ৩১-৩২

Leave a Reply