অতিক্রান্ত হচ্ছে সময়। এগোচ্ছে মানব সভ্যতা। শিক্ষা সংস্কৃতি থেকে প্রযুক্তিগত দিক, কালের বিবর্তনে পরিবর্তিত হচ্ছে সবকিছুর। বর্তমান মানব সভ্যতার এই উন্নতি অনেকাংশে এগিয়ে দিচ্ছে সারা বিশ্বকে। কিন্তু সবকিছুর উন্নতি হলেও মানুষের দৈহিক রোগ কিন্তু পিছু ছাড়ছে না। মনুষ্যজাতির অগ্রসরে কোথাও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিভিন্ন শারীরিক রোগগুলি। সম্পর্ক, কাজকর্ম ও সামাজিক মেলামেশার উপরেও প্রভাবিত হচ্ছে শারীরিক রোগ। আজ আমরা এরকম একটি রোগ সম্পর্কে আলোচনা করব। যার নাম ‘অ্যাসপারগার সিন্ড্রোম’।
অস্ট্রীয় শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ হ্যান্স অ্যাসপারগার এর নামানুসারে এই লক্ষণসমূহের নামকরণ হয়েছে। এটি একটি স্নায়ুগত বিশৃঙ্খলাজনিত রোগ লক্ষণ সমষ্টি। যাকে ইংরেজিতে Autism Spectrum Disorder বা ASDs বলে। অ্যাসপারগার সিন্ড্রোম হল অর্টিজম স্পেক্ট্রামের অংশ। যাকে বলে ‘নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার’। অর্টিজম স্পেকট্রাম থাকার কোন দৃষ্টিগোচর বৈশিষ্ট্য নেই তাই তাকে “গোপন অক্ষমতা” বলা হয়। এরা সাধারণত প্রবল উদ্দীপকের অনুভূতি সহ্য করতে পারে না এবং প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়ে। বাস্তব জীবনে চলবার জন্য প্রয়োজনীয় নানা দক্ষতার অভাব দেখা যায়।
সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতবর্ষের তুলনায় বাইরের দেশে এই রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের ২০১৪ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী প্রতি ৬৮ জন নবজাতকের মধ্যে ১জন অ্যাসপারগার সিন্ড্রোমে আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে মোট জনসংখ্যার প্রায় ১.১ শতাংশ মানুষের অটিজম স্পেকট্রামে রয়েছে। আধুনিক গবেষণা অনুযায়ী উল্লেখ্য, প্রতি হাজারে ১-২ জনের অর্টিজম এবং এক হাজারে ৬ জন এ এস ডি(ASDs) রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
রোগের কারণ
এই রোগের প্রকৃত কারণ কিন্তু এখনও পর্যন্ত অজ্ঞাত। তবে, মেয়েদের তুলনায় পুরুষদের এই রোগ বেশি হয়। তবে প্রাথমিকভাবে বলা যায়-
১) জিনগত, পরিবেশগত ও পরিবার গত কারণে এগুলি দেখা দেয়।
২) গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত নেশা করা বা রাসায়নিক বিক্রিয়ার সম্মুখীন হওয়া বা ভাইরাসঘটিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণেও হতে পারে।
৩) সেবন করা কিছু ওষুধ থেকেও এই রোগ হতে পারে। যেমন,ভ্যাল্প্রোইক অ্যাসিড এবং থ্যালিডোমাইড (এটি গর্ভাবস্থায় খাওয়া হয়)।
৪) বিলম্বিত গর্ভধারণের ফলেও শিশুর অ্যাসপারগার সিন্ড্রোম হওয়ার বিপদ বেড়ে যায়। ৫) বয়ঃবৃদ্ধির সময়ে সামাজিক সংকেত বুঝতে না পারার ফলে বা অন্যের সাথে আলাপচারিতায় জড়তা হওয়ার ফলে জন্মানো হতাশা, উদ্বিগ্নতা ও কি করতে হবে তা বুঝতে না পারার ক্ষমতা থেকেও এই লক্ষণ সমষ্টি প্রকাশ পায়।
লক্ষণ
এই রোগের যে লক্ষণগুলি দেখে বোঝা যায় কোনও শিশু বা ব্যাক্তি অ্যাসপারগারে আক্রান্ত, সেগুলি হল-
১) জন্মের পর প্রথম বছর বয়সের মধ্যে শিশুদের এই ধরনের রোগ লক্ষণ সমষ্টি প্রকাশ পেয়ে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। সঠিক বা প্রত্যাশিত সামাজিক আচরণ করতে এরা ব্যর্থ হয়। অন্যের মনের অবস্থা বোঝার ক্ষমতার অভাব দেখা দেয়।
২) অস্বাভাবিক কথাবার্তা বলা ও কোনও কিছুর প্রতি নিবিড়ভাবে আগ্রহের অভাব।
৩) একটি জিনিস বা ধারনাকে বোঝানোর জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বর্ণনা প্রদান করা।
৪) ক্ষেত্র অনুযায়ী স্বরের উচ্চতা নীচতা ব্যবহারের ও মুখের ভাব-ভঙ্গি বোঝা বা বোঝানোর অভাব।
৫) চোখ বা মুখের দিকে চেয়ে কথা না বলা।
৬) একই ধরনের বাধা দেওয়া কাজ বারংবার করা বা একই কথা বারবার বলা ইত্যাদি এই রোগের লক্ষণ।
৭) এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির শিখন-এর সমস্যা থাকতে পারে। সুনির্দিষ্ট কিছু কাজ কিংবা বিষয়ে প্রবল আকর্ষণ থাকতে পারে এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রখর ও দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিশক্তি থাকতে পারে। যেমন- এই ধরনের শিশুর কোনো যান্ত্রীক মডেলের সম্পর্কে আগ্রহ থাকলে সে হয়ত অগুনতি যান্ত্রীক মডেলের নাম্বার এবং বিবরণ সহজেই শিখে ফেলতে পারে। কিন্তু অন্য অনেক সাধারণ কাজ এরা করে-উঠতে পারে না।
৮)জীবনযাত্রার বা পড়াশোনার পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটানো হলে অ্যাসপারগারে আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে প্রবল সমস্যা হয় এবং শিক্ষার্থীর বিকাশেও গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
উল্লেখ্য, অ্যাসপারগারে আক্রান্ত ব্যক্তিকে অনেক সময় আক্রমণাত্মক বলে মনে করা হয়ে থাকে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে অ্যাসপারগারের লক্ষণে আক্রান্ত মানুষ সাধারণতঃ অন্যকে আক্রমণ করেনা, বরং অন্যের সামাজিক অত্যাচার সহ্য করে থাকে।
চিকিৎসা
এই রোগের তেমন কোনও ঔষধগত (Medicinal Treatment) চিকিৎসা নেই। তবে এই রোগের উদ্বিগ্নতা কমানোর ঔষধ ব্যবহার করা যেতে পারে। দৈনিক ভিটামিনযুক্ত খাবার ও মৎস্য তেল (Fish oil) খাওয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এছাড়া আকুপাংচার (Acupunctere) , স্পীচ থেরাপির সাহায্যে ভাব আদান-প্রদানের দক্ষতা বাড়ান, মিউজিক থেরাপি ও ম্যাসাজ এই প্রবণতা দূর করার সহায়ক হতে পারে। এই রোগ সারিয়ে তোলার ক্ষেত্রে বড় দায়িত্ব নিতে হয় মূলত বাবা-মা বা রোগীর সহচার্যে থাকা সকলকেই। রোগীকে ক্ষেত্রনুযায়ী উপযুক্ত কথা বলা শেখানো, সামাজিক মেলবন্ধন তৈরি করার প্রবণতা বাড়ানো, কথা বলার কৌশল ও বলার সময় মুখের ভঙ্গিমা ঠিক করার কৌশল নিবিড়ভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। শারীরিক, সামাজিক, ব্যবহারিক শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এই রোগ সম্পূর্ণভাবে ঠিক করা যায়না। তবে পারস্পারিক সহযোগিতা, বোঝাপড়া এবং সঠিক প্রশিক্ষণ রোগীকে দীর্ঘসময় সুস্থ ও উন্নত জীবনযাপন করতে সাহায্য করে।