বিবিএসের জরিপ, করোনার চেয়ে ৩৬ গুণ বেশি মৃত্যু হয় হৃদ্রোগে। আমাদের সবার মধ্যে একটা উপলব্ধি কাজ করে এমন যে করোনায় অনেক বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। কিন্তু পারসেপশন সব সময় সঠিক হয় না। করোনার চেয়েও বেশি মানুষ মারা গেছে হৃদ্রোগে। আপনি কতটুকু সচেতন, আপনি কি হৃদ্রোগের ঝুঁকিতে আছেন? যদি ঝুঁকিতে আছেন বলে মনে হয়, তাহলে কী করবেন? সাধারণ হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাবেন। হৃদ্রোগে বিকল্প চিকিৎসা আকুপ্রেশার এখন বেশ সাড়া ফেলেছে। আপনি আপনার হাত চেপে জেনে নিতে পারবেন, আপনি হৃদ্রোগের কতটুকু ঝুঁকিতে আছেন, বিশেষ করে যদি কোনো উপসর্গ না–ও থাকে।
করোনারি হৃদ্রোগ কী
করোনারি হৃদ্রোগ (সিএইচডি) করোনারি ধমনির মধ্যে বাধা সৃষ্টি করে বা পাতলা হয়ে যায়, সাধারণত যা অ্যাথেরোসক্লেরোসিসের দ্বারা সৃষ্ট। ধমনির অভ্যন্তরীণ দেয়ালে কোলেস্টেরল ও চর্বি জমে যায়, তাকে অ্যাথেরোসক্লেরোসিস (ধমনির ‘শক্ত হয়ে যাওয়া’ বা ‘ক্লগিং’ নামেও পরিচিত) বলা হয়ে থাকে। এই চর্বি ধমনিতে রক্ত চলাচলের গতি কমিয়ে দিয়ে হৃৎপিণ্ডে রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। এ কারণে হৃৎপিণ্ডে রক্ত সরবরাহ কমে যায়। হৃৎপিণ্ডকে স্বাভাবিক রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে অক্সিজেন এবং বিভিন্ন মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস হৃৎপিণ্ডে পৌঁছাতে পারে না। এ কারণে বুকে ব্যথা হতে পারে। যদি হৃৎপিণ্ডের একটি পেশিতে রক্তপ্রবাহ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়, অথবা শরীর থেকে যে পরিমাণ শক্তি হৃৎপিণ্ডে যাওয়ার কথা, সেগুলো না গেলে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।
সাধারণভাবে হার্ট–সংক্রান্ত যেকোনো অসুখকেই হৃদ্রোগ বলা হয়ে থাকে। যেটাকে এখন বর্তমান সভ্যতার রোগ বলা হয়। এ রোগের কয়েকটি ধাপ আছে, তেমনি আলাদা নামও রয়েছে, যেমন করোনারি হৃদ্রোগ, কার্ডিও মায়োপ্যাথি, উচ্চ রক্তচাপজনিত হৃদ্রোগ, হার্ট ফেইলিউর, হৃৎপিণ্ডের ডান পাশ অচল হয়ে যাওয়া, শ্বাসপ্রশ্বাস ব্যাহত হওয়া, ভালভুলার ডিজিজ ইত্যাদি হার্টের অসুখের মধ্যে পড়ে।
মানুষের হৃৎপিণ্ডের মধ্যে করোনারি আর্টারি নামে দুটি ছোট ধমনি থাকে। এই ধমনিই হৃৎপিণ্ডকে সচল রাখতে সাহায্য করে বা হৃৎপিণ্ডকে পুষ্টির জোগান দেয়। কোনো কারণে এই করোনারি আর্টারি যদি ব্লক হয়ে যায়, তাহলে যে এলাকায় ওই আর্টারি বা ধমনি রক্তের পুষ্টি পৌঁছে দিতে পারে না, সেই জায়গার হৃদ্পেশি কাজ করে না। তখনই হার্ট অ্যাটাক হয়। এ সমস্যা যেকোনো সময় যে কারও হতে পারে। কাজ করতে করতে, ঘুমের ঘোরে সকাল-রাতে যেকোনো সময় হতে পারে। হঠাৎ ভারী কোনো কাজ করলে, বাইরে ঠান্ডা আবহাওয়ায় থাকলেও এ রোগ হতে পারে। অনেক সময় এই সমস্যাগুলো নিঃশব্দে দানা বাঁধে।
হার্ট অ্যাটাক হতে যাচ্ছে, তখন যে লক্ষণ থাকে
সাধারণভাবে হার্টের অসুখ থাকলে বুকে অসহ্য ব্যথা অনুভূত হয়। সেই সঙ্গে ঘাম হয় এবং শরীর খারাপ ও অস্বস্তি লাগে। ক্রমাগত শরীর খারাপ করতে থাকলে হার্টের অসুখ হতে পারে। হার্টের করোনারি আর্টারি বা ধমনি ব্লকেজ থাকলে মানুষের শরীরে নানা সমস্যা হয়। বুকে ব্যথা, ঘাম, নিশ্বাসে কষ্ট, মাথা ধরা—এসব লক্ষণ দেখলে বোঝা যায়, রোগীর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। হাতে-পায়ে ঝিনঝিনও করতে পারে। মূলত রক্তে এলডিএল (খারাপ) কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়া এবং এইচডিএলের (ভালো) মাত্রা কমে গেলে মানুষের হার্ট অ্যাটাক হয়।
এমন সমস্যা হলে আপনি নিয়মিত আকুপ্রেশার করতে পারেন। সেই সঙ্গে খাদ্য ও জীবনযাপনে কিছু পরিবর্তন এনে ফেলুন। তাতে আপনার সমস্যাগুলো আস্তে আস্তে দূর হবে এবং সেই সঙ্গে উপসর্গগুলো থাকবে না।
কীভাবে আকুপ্রেশার শুরু করবেন
হার্টের যে সমস্যাই হোক, আপনি আকুপ্রেশার শুরু করার আগে আপনার জীবনধারায় একটু পরিবর্তন আনার চেষ্ট করুন। বিশেষ করে খাদ্যে শৃঙ্খলা আনতে হবে। আপনার খাবার হবে ফল ও সবুজ শাকসবজিনির্ভর। সেই সঙ্গে দানাদার শস্য ও বাদাম খেতে পারবেন। তারপর প্রতিদিন সকালে ২০ থেকে ২৫ মিনিট আকুপ্রেশার করবেন।
আকুপ্রেশার শুরু করার প্রথম নিয়ম হচ্ছে আপনি আপনার দুই হাত ঘষুন। দুই মিনিট এমনভাবে হাতের তালু ঘষবেন, যেন হাত লাল ও গরম হয়ে ওঠে। তারপর ছবিতে দেওয়া পয়েন্টেগুলোর প্রতিটিতে ১০০ বার করে আকুপ্রেশার করুন। হার্টের পয়েন্টগুলো মূলত আমাদের হাতের বাঁ হাতে হয়ে থাকে। আকুপ্রেশার করার জন্য কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। আপনার বাঁ হাত ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে চাপ দিন।
ছবি– ৪ ক্যাপশন:
বাঁ হাতের সাতটি স্থানে ও ডান হাতের চারটি স্থানে আকুপ্রেশার করবেন। প্রেশার হবে খুব হালকাও না বেশি জোরেও না। আপনি যখন আঙুল দিয়ে বাঁ হাতের পয়েন্টগুলোতে চাপ দেবেন, তখন আপনি হালকা ব্যথা অনুভব করবেন। যেখানে আপনি ব্যথা অনুভব করবেন, সেখানেই আপনার পিনপয়েন্ট। প্রতিদিন সকালে ও রাতে শোয়ার আগে অবশ্যই খালি পেটে আকুপ্রেশার করতে হবে। সপ্তাহে ছয় দিন আকুপ্রেশার করুন, আর এক দিন বিরত থাকুন।
সব কটি পয়েন্টে আপনি এক সপ্তাহ আকুপ্রেশার করলেই টের পাবেন, আপনার শরীরে কিছুটা পরির্বতন আসছে, বিশেষ করে বুকটা হালকা লাগবে, শ্বাস ফেলতে তেমন কষ্ট হবে না, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে যে কষ্ট হতো, তা ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকবে। এই নিয়ম তিন মাস করা উচিত। যাঁরা অসুস্থ আছেন, তাঁরাই যে আকুপ্রেশার করবেন, তেমনটি নয়; বরং আপনিও হার্ট ভালো রাখতে নিয়মিত আকুপ্রেশার করতে পারেন।
হার্ট ভালো রাখার জন্য খাবারের মধ্যে আমাদের মৌসুমি ফল অনেক ভালো। সেই সঙ্গে আপেল আর নিয়মিত কলা, পেঁপে খেয়ে শরীরকে সচল রাখা জরুরি। বিশেষ করে সারা দিনে আপনার খাবারে তেল ও লবণের পরিমাণ কমানো আবশ্যক। এ জন্য ফল ও কাঁচা সবজির সালাদ হতে পারে আদর্শ খাবার।
হার্টের সমস্যাগুলো শরীরে ধীরে ধীরে জন্মালেও অ্যাটাক হয় খুব দ্রুত। এ কারণে মানুষের বিপদ বেড়ে যায়। হৃদ্রোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় আপনি আকুপ্রেশার করে আপনার পরিবারকে বিপদমুক্ত রাখতে পারবেন।
লেখক: খাদ্য, পথ্য ও আকুপ্রেশার বিশেষজ্ঞ।
ছবি: লেখক
Prothom Alo link: হার্ট ভালো রাখতে আকুপ্রেশার