শরীরের পক্ষে পুষ্টিকর এবং উপযোগী সব তত্ত্ব পাওয়ার জন্যে এবং ভিটামিন সি পাওয়ার জন্যে সবুজ শাক খাওয়া খুবই জরুরি। প্রায় সব শাকেই অ্যালকলি ক্ষারজ বা ক্ষার পদার্থ বেশি। সবুজ শাকের মধ্যে নটে শাকের আছে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এটি অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ শাক এবং দামেও সস্তা।
নটে শাক সাধারণত বাজারে দু ধরনের পাওয়া যায় সবুজ নটে ও রাঙা নটে। আর এক রকমের নটে শাক হল কাঁটা নটে। নটে শাকের শিকড় ও পাতা নানা রোগে ওষুধ হিসেবেও খাওয়া হয়। সবুজ নটে শাকের চেয়ে লাল নটে শাকই বেশি উপকারী নটে শাক হিন্দিতে যার নাম চৌলাই গরমকালে আর বষাকালেই অধিক জন্মায়। গরমকালে আর বর্ষাকালের বদহজম বা হজমের গোলমাল থেকে নটে শাক শরীরকে মুক্ত রাখে। এই দুই কেতুতেই এই শাকের ফলন ও হয় খুব এবং বাঙালি বাড়িতে ওই শাকের ভাজা ও চচ্চড়ি খাওয়াও হয় খুব। এই শাক সহজে হজম হয় অর্থাৎ লঘু পাক ও হালকা আহার। নটে শাক ভাজায় আছে অনেক গুণ। কাজেই গরমকালে ও বর্ষাকালে নটে শাক ভাজা তো শরীরের পক্ষে ওষুধের কাজ করে। নটে শাকের কচি পাতা খেলে (ভাজা বা চচ্চড়ি হিসেবে কিংবা সেদ্ধ করে অল্প তেল নুন দিয়ে মেখে ভাতে হিসেবে, বড়ি বেগুন মুল্লো দিয়ে ঘন্ট রান্না করে) মল পরিষ্কার হয়, শরীরের পক্ষে শীতল অথাৎ গরমে শরীর ঠাণ্ডা রাখে, রক্তের দোষ দূর করে অর্থাৎ রক্ত পরিষ্কার করে এবং পথ্যকারক অর্থাৎ পথ্য হিসেবে উপকারী। আর একটি নতুন পদ্ধতিতে নটে শাক খেয়ে দেখতে পারেন। নটে শাক অল্প তেলে নেড়েচেড়ে নিয়ে, জল ও আন্দাজ মতে নুন মিশিয়ে সেদ্ধ করে নিন। নামাবার আগে কাঁচা আমের কুচি বা একটু ঘোল মিশিয়ে দিন। খেতে ভালই লাগবে শরীরের পক্ষেও ভাল ।
গুজরাতিরা নটে শাক ভাজায় বেসন, টক দই, হিং ইত্যাদি মিশিয়ে কড়হি বা টক ঝোল-ঝোল তরকারি তৈরি করেন। এটিও যেমন উপকারী গরম ভাতের সঙ্গে তেমনই সুস্বাদযুক্ত। খেলে মুখের রুচি ফেরে।
সুস্থ থাকতে নটে শাক:
১. রক্তের দোষ দূর করতে: যদি শরীর গরম হওয়ার দরুণ বা যে কোনো কারণে রক্তের দোষ ঘটে এবং সেই কারণে চুলকুনি হয় তাহলে নিয়মিত নটে শাক ভাজা খেলে উপকার পাওয়া যায়। কুষ্ঠ রোগ, শরীর জ্বালা, লিভার ও পিত্তের অসুখেও নটে শক উপকার দেয়।
২. গ্রীষ্মকালীন রোগ সারাতে: গরমকালের নিয়মিত নটে শাক ভাজা খেলে অনেক রোগ সারে যায়। এছাড়া যাঁরা অসুস্থ তাঁদেরও নটে শাক খাওয়ানো যেতে পারে কারণ নটে শাক খেলে কোনো অপকার হবে না। যদি সম্ভব হয় গরমকালে ও বর্ষাকালে অর্থাৎ নটে শাক যখন বাজারে প্রচুর পাওয়া যায় ও দামে সস্তা প্রতিদিন নিয়ম করে ভাতের সঙ্গে নটে শাক ভাজা, চচ্চড়ি, ভাতে বা ঘণ্ট খান অনেক রোগের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবেন। এই সব গুণের জন্যেই তো নটে শাককে বিষয় বলা হয়। তা ছাড়া সব রকম বিষের ক্রিয়া নাশের পক্ষেই নটে শাক হল সবচেয়ে সুলভ, সস্তা, সহজ ও অব্যর্থ ওষুধ।
৩. মেয়েলি অসুখেও: নটে শাক খুব উপকারী। অনেক রোগেরই সুলভ, সস্তা, সহজ ও ঘরোয়া ওষুধ। যন্ত্রণাদায়ক প্রমেহ, যৌনব্যাধি ও প্রস্রাবের অসুখ শরীর যদি ফুলে ওঠে এবং ব্যথা করে সেই যন্ত্রণাও নটে শাক খেলে শান্ত হয়।
৪. বুকের দুধ বাড়ায়: যে সব মায়েরা বাচ্চাদের দুধ খাওয়ান তাঁরাও নটে শাক ভাজা খেলে সুফল পাবেন কারণ নটে শাক স্তন্যদুগ্ধব।
৫. আয়ুর্বেদের মতে: নাটে শাকের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে। সব রকমের বিষ, সব রকম ধাতর বিষ দূর করতে নটে শাক ব্যবহার করা হয়। এই সব বিষ- থেকে উৎপন্ন রক্তের দোষে নটে শাক উপকারী। এছাড়াও চোখ খারাপ হওয়া, উদররোগ বা পেটের রোগ, পেটের অসুখ, পুরোনো পেটে অসুখ, পেটে মোচড় দেওয়া, নাক মুখ থেকে রক্তপড়া বা পিত্ত, অশ, কোষ্ঠকাঠিন্য, লিভারের দোষ, পিলে বেড়ে যাওয়া অর পুরোনো জ্বরে নটে শাক খুব কাজ দেয়।
৬. ত্বকের সব অসুখ সারে: ত্বকের রোগ, এমনকি কুষ্ঠরোগ, চর্মরোগেরও নটে শাক খেলে উপশম হয়। নটে শাকের রসে চিনি মিশিয়ে খেলে চুলকুনি সারে, শরীরের গরম হয়। নটে শাক ভাজা বা যে কোনো রকমভাবেই এই শাক নিয়মিত খেলে এসব রোগের কষ্টের হাত থেকে অনেকটা নিষ্কৃতি পাওয়া যায়।
৭. মায়েদের জন্য উপকার: যাঁরা মা হতে চলেছেন, যাঁরা ছোট শিশুর মা, যাঁরা সদ্য মা হয়েছেন সেসব মেয়েরাই নটে শাক খেলে উপকার পাবেন। যাঁরা শরীরের দিক থেকে খুব দুর্বল তাঁদেরও নির্ভয়ে খেতে দেওয়া যেতে পারে।
৮. চোখের সমস্যায়: চোখের সব অসুখেই নটে শাক উপকারী। চোখ জ্বালা করা, চোখ লাল হওয়া, চোখে পিচুটি জমা, চোখের পাতা পিচুটিতে জুড়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রভৃতি সব অসুখ ও অস্বস্তি দূর করবার জন্যেই নিয়মিত যথেষ্ট পরিমাণে নটে শাক খাওয়া উচিত।
৯. শরীর সুস্থ রাখতে: নটে শাক মধুর, পরিপাকেও মধুর, শরীরের পক্ষে শীতল, খিদে বাড়ায়, মলমূত্রের শুদ্ধি করে। সেইজন্যে রোগী বা সুস্থ সব রকম মানুষরে জন্যেই সমান উপকারী। পিত্তের গরমের জন্যে যে জ্বর তারও উপশম হয় নটে শাক খেলে।
১০. অস্ত্র দুর্বলতা দূর করতে: নটে শাকের রস মধুর ও শরীর ঠাণ্ডা করে। যাঁদের অস্ত্র দুর্বল হয়ে গেছে তাঁদের পক্ষে উপকারী। এতে ক্ষারদ্রব্য (লবণ) ও রেশ (আঁশ বা ছিবড়ে) আছে বলে অন্ত্রের মধ্যে জমা পুরনো মল বহিষ্কার করে এবং পুরনো কোষ্ঠ কাঠিন্য রোগ সারিয়ে তোলে।
১১. কোষ্ঠকাঠিন্যে দূর করতে: যদি কোনো বৃদ্ধ যিনি কোষ্ঠকাঠিন্যে ভূগছেন তিনি নিয়মিত এই শাক খান তাহলে তাঁর এই কষ্ট দূর হবে এবং শরীরও পুষ্টি লাভ করবে।
১২. উদররোগের উপকার: নটে শাকের রস বের করে জলে মিশিয়ে খেলে বা নটে শাকের ভাজা, ঘন্ট, চচ্চড়ি ইত্যাদি খেলে উদররোগের উপকার হয়।
১৩. রক্তপিত্ত সারাতে: নটে শাক ভাজা, নটে শাকের রস বা নটে শাকের পাতা পিষে নিয়ে খেলে রক্তপিত্ত সারে, নাক মুখ থেকে রক্তপড়া বন্ধ হয়।
১৪. জ্বালা-পোড়া: নটে শাকের রসে অল্প চিনি মিশিয়ে খেলে পা বা হাতের তালু (চেটো) জ্বালা করা, প্রস্রাব করতে গেলে জ্বালা করা, বার বার প্রস্রাব হওয়া ও জ্বালা করা সারে। কাঁটা নটে শাক খেলে প্রমেহ সারে। মূত্র কম হওয়ার জন্যে শরীর জ্বালা করার কষ্টটা মূত্রবৃদ্ধি অর্থাৎ পরিষ্কার প্রস্রাব হয়ে গিয়ে দূর হয়ে যায়।
১৫. প্রদর রোগ সারে: নটে শাক বা কাঁটা নটের মূল বা শিকড় পিষে জলে সেদ্ধ করে কাথ তৈরি করে সেই কাপের ২ চা চামচ তার সঙ্গে মধু ২ চা চামচ এবং ভাতের ফ্যান ৮ চা চামচ মিশিয়ে খেলে মেয়েদের সব রকমের প্রদর রোগ সারে। এছাড়াও নটে শাকের মূল বা শিকড় পিষে নিয়ে তার সঙ্গে ভাতের ফ্যান মিশিয়ে খেলেও প্রদর রোগে উপকার পাওয়া যায়।
১৬. রক্তস্রাব বন্ধ করতে: নটে শাকের মূল বা শিকড় পিষে নিয়ে তার সঙ্গে ভাতের ফ্যান মিশিয়ে খেলে প্রসূতির (যে মেয়ের বাচ্চা হয়েছে) এবং সগর্ভার (যার বাচ্চা হবে) রক্তস্রাব বন্ধ হয়। যদি কোনো কারণে যে মেয়ের বাচ্চা হবে তার রক্তস্রাব আরম্ভ হয় এবং বাচ্চা বা গর্ভ নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় নটে শাকের শিকড় বাটার সঙ্গে ভাতের ফ্যান মিশিয়ে খেলে গর্ভ স্থির হয় এবং অজাত শিশু বা ভূণ নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়।
১৭. পিত্তের দোষ দূর করে: রক্তবিকার অর্থাৎ রক্তের দোষ এবং পিত্তবিকার অথাৎ পিত্তের দোষে কাঁটা নটেরশাক খুব উপকারী।
১৮. প্রস্রাবের সমস্যা দূর করতে: কাঁটা নটে শাকের ক্ষার বা লবণ তৈরি করে নিয়মিত খেলে প্রস্রাব কম হওয়া (মূত্রকৃচ্ছতা) মূত্রাঘাত (প্রস্রাব করতে গেলে জ্বালা করা) আর পাথরি রোগ সেরে যায়।
১৯. পাথরি রোগ দূর করতে: পাথরির (কিডনি বা গল ব্লাডারে পাথরে হলে) জন্যে তীব্র যন্ত্রণা হলে নটে শাকের ক্ষার চার টেবিল নটে শাকের রসে মিশিয়ে ঘন্টয় একবার করে দু-তিনবার খাওয়ালে অনেক সময় পাথর ভেঙে বেরিয়ে যায়। এই ক্ষার কবিরাজি দোকানে কিনতে পাওয়া যায়।
২০. শরীরের বিষ দূর করতে: পারদ বা অন্য ধাতুর বিষের নটে শাকের রসের সঙ্গে অল্প শুদ্ধ ঘি মিশিয়ে আট দিন নিয়ম করে খেলে উপকার পাওয়া যায়। নটে শাক ভাজা খেলেও এক্ষেত্রে উপকার পাওয়া যায়। শরীরের ধাতুর সঙ্গে এই বিষ বেরিয়ে যায় এবং আরাম পাওয়া যায়। নটে শাকের রস শরীরে লাগিয়ে স্নান করলেও উপকার হয়।
২১. আগুনে পোড়া ও ব্রণ: আগুনে পোড়া ঘা বা ব্রণতে নটে শাকের রস লাগালে ঘা বা ব্রণ দূর হয়।
২২. ফোঁড়া সারাতে: নটে শাকের পুলটিস তৈরি করে ফোড়ার ওপর বাঁধলে ফোড়া তাড়াতাড়ি পেকে ফেটে যায়। ফোলার ওপর নটে শাক বাটার প্রলেপ লাগালে ফোলা কমে।
২৩. ইঁদুরের কামড়ে: নটে শাকের রস গরুর দুধে মিশিয়ে খেলে বিষ নেমে যায়। ১ চা চামচ নটে শাকের শিকড়ের চূর্ণ (গুঁড়া) ১ চা চামচ মধু মিশিয়ে দিনে দু বার করে চেটে খেলে শরীর থেকে ইদুরের বিষ নেমে যায়।
২৪. বিছের কামড়: নটে শাকের রসে চিনি মিশিয়ে খেলে বিছের কামড়ের বিষও নেমে যায়। ২৫. শরীরের দোষ দূর করতে: নটে শাকের রসে বা শিকড়ের ক্বাথের সঙ্গে গোলমরিচ মিশিয়ে খেলে বা রোগীকে বেশি পরিমাণে নটে শাক ভাজা খাওয়ালে শরীর থেকে সব রকমেরই বিধ-দোষ দূর হয়।
এছাড়াও আয়ুর্বেদ মতে, নটে শাক হালকা অথাৎ পাচনে গঘু, শীতল, তৈলহীন, প্রাক ও মল নিষ্কাশনে সাহায্য করে, রুচি উৎপন্ন করে; খিদে বাড়ায়, বিষ দূর করে, কফ, পিত্ত ও রক্ত বিকার (রক্তের দোষ) দূর করে।
সুশ্রুতের মতে, নটে শাক অত্যন্ত শীতল, রস ও পরিপাকে মধুর, রক্তপিত্ত (নাক মুখ থেকে রক্ত পড়া), মদ ও বিষের দোষ নাশ করে।
নটে শাক ভাজা খাওয়ার নিয়ম : বেশি উপকার পেতে হলে নটে শাক প্রথমে সেদ্ধ করে নিন। তার পরে অল্প ঘিয়ে সাঁতলে নিন। এইভাবে ভাজুন। তেল দিয়ে রান্না করবেন না বেশিক্ষণ সেদ্ধও করবেন না তাহলে গুণ নষ্ট হয়ে যাবে।
বৈজ্ঞানিক মতে, নটে শাকে ভিটামিন এ, বি আর সি আছে। নটে শাক রক্তবর্ধক, রক্ত গরম হওয়া দূর করে মেজাজ ঠাণ্ডা রাখে, রক্ত শোধন করে, জীবাণু নাশ করে এবং সহজে হজম হয়। এই শাকে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, গন্ধক, তামা প্রভৃতিও আছে। নটে শাকের নরম কচি পাতা ও নরম কচি ডাঁটায় প্রোটিন, খনিজ, ভিটামিন এ ও সি প্রচুর মাত্রায় পাওয়া যায়।
কাঁটা নটে বা বুনো নটে অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতার ওষুধ ; গ্রামাঞ্চলে ঝোপে-জঙ্গলে এই শাক প্রচুর পরিমাণে হয়। নটে শাকের চেয়ে এই শাকের পাতা ছোট এবং সারা গায়ে থাকে ছোট ছোট কাঁটা। গ্রামবাসীরা এই শাক ভাজা বা এই শাক ও উচ্ছে দিয়ে চচ্চড়ি রান্না করে খেয়ে রক্তাল্পতার হাত থেকে নিষ্কৃতি পান। শরীরে রক্তবৃদ্ধি হয় ও অ্যানিমিয়া সারে।
আয়ুর্বেদ মতে, কাঁটা নটে শীতল, রুচিকর, কাশি, শরীর জ্বালা করা, অর্শ, শোথ (শরীর ফুলে ওঠা) রক্তপিত্ত (নাক, মুখ থেকে রক্তপড়া) ও বিষদোষে উপকারী।
তথ্যসূত্রঃ
১. সাধনা মুখোপাধ্যায়: সুস্থ থাকতে খাওয়া দাওয়ায় শাকসবজি মশলাপাতি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, নতুন সংস্করণ ২০০৯-২০১০, পৃষ্ঠা, ১৩৪-১৩৯।