ন্যাচারোপ্যাথি, মশলা

জায়ফল খাওয়ার গুনাগুণ

জায়ফল খেলে অরুচি দুর হয়। জায়ফল সুগন্ধযুক্ত গরম মশলায় ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও ব্যবহার করা হয় নানা রকম মিষ্টি বা রান্নায়। ঘরোয়া ওষুধ হিসেবেও জায়ফল ব্যবহার করা। চিকিৎসকদের মতে, জায়ফল সুগন্ধি, পাচক (খাবার জুম করায়), উষ্ণ, বায়ুনাশক, খিচুনি বন্ধ করে। অল্প মাত্রায় খেলে খিদে পায়, হজম তাড়াতাড়ি হয়। পেটফাঁপা, পেটের অসুখ, শূল প্রস্রাব কম হওয়া (মূত্রকৃচ্ছতা) ইত্যাদি অস্বঞ্জি বা অসুখ উপশম করে।

আয়ুর্বেদ মতে, তিক্ত, কটুরস, তীক্ষ্ণ, উষ্ণ, রুচিকর, বলকর, লঘু, কফ-বাত-পিত্ত অথাৎ ত্রিদোষীরক, অগ্নিউদ্দীপক (খিদে বাড়িয়ে দেয়), গায়ের রং পরিষ্কার করে (বর্ণপ্রসাদক), মলরোধ করে, স্বরবর্ধক, বায়ু কফ, মুখের অরুচি, মলের দুর্গন্ধ, কৃমি, বমি দূর করে। গায়ের রঙের কালচে ভাব কৃষ্ণবর্ণতা কমিয়ে দেয়। মাথার রোগ, ব্রণ, মেহ, শ্বাস, সাইনাস, সর্দি, হার্টের অসুখে সুফল দেয়। পুরোনো পেটের অসুখ, পেটফাঁপা, খিচুনি, শূল, আমবাত, মুখের দুর্গন্ধ ও দাঁতের ব্যথায় স্বস্তিভাব আনে। খাওয়ার পরিমাণ এক বা দুই গ্রাম। ভাবপ্রকাশ মতে, মুখের মেচেতা বা কালচে নীলচে ভাব দূর করতে জায়ফল ঘষে তার প্রলেপ লাগালে উপকার পাওয়া যায়। সেনের মতে, কুষ্ঠরোগের ক্ষত বা ঘায়ে লাগালে ঘা বা ক্ষতের উপশম হয়।

জায়ফল খাবার হজম করায় এবং মলরোধ করে বলে পেটের অসুখ (অতিসার) রক্ত আমাশা যুক্ত পেটের অসুখ (রঞ্জাতিসার), গা বমি ভাব এবং বমি হলে জায়ফলের চুর্ণ পরিমাণ মতো খাওয়ানো হয়। মাথা ব্যথা, বাত, হাত পা আকড়ে যায় (ক্র্যাম্প) প্রভৃতি অসুখে জায়ফলের প্রলেপ লাগালে উপকার পাওয়া যায়। পরোনো বাত বা পক্ষাঘাতে সর্ষের তেলের সঙ্গে জায়ফল ফুটিয়ে মালিশ করলে সুফল পাওয়া যায়।

হাকিমি বা ইউনালি মতে, উষ্ণ প্রকৃতির লোক এবং যাঁদের পিত্তের ধাত তাঁদের ফুসফুস ও যকৃতের পক্ষে জায়ফল অপকারী। জায়ফল খেলে তাঁদের মাথা ব্যথা করবে। কিন্তু যাঁদের প্রকৃতি শীতল তাঁরা জায়ফল খেলে ঠাণ্ডার জন্যে যে সব অসুখ সেগুলোর উপশম হয়ে রতিশক্তি বাড়বে এবং মন প্রফুল্ল হবে। মাত্রা ১ থেকে ২ গ্রাম জায়ফল খাবার হজম করায়, পাকস্থলী ও প্লীহ সবল করে। জায়ফল খেলে লিভার ও প্লীহার ফুলে ওঠা সেরে যায় এবং পাকস্থলীর বদরস দূর হয়।

সুস্থ থাকতে জায়ফলের ব্যবহার বা প্রয়োগ:

১. বাত ও ব্যথায়: গেঁটে বাতে জায়ফলের তেল মালিশ করলে উপকার পাওয়া যায়। জায়ফলের তেল সর্ষের তেলের সঙ্গে মিশিয়ে সন্ধি বা গাঁঠের পুরনো ব্যথায় বা ফোলায় মালিশ করলে সেই জায়গাটা গরম হয়ে যায়, অসাড় অঙ্গে সাড় আসে, ঘাম বেরোয়, সন্ধিবাতের জন্যে আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া সন্ধিস্থল আবার সচল হয় এবং সন্ধিবাতের (গেঁটেবাত) উপশম হয়।

২. বহুমূত্রে: সঠিক পরিমাণে খেলে বহুমূত্র (ডায়াবেটিস) রোগ সারে।

৩. চোখের রোগে: চোখের চুলকুনিতে জায়ফলের প্রলেপ লাগালে উপকার হয়। জায়ফলের সুর্মা পরলে চোখের রোগে উপকার হয়।

৪. পেটের অসুখে: জায়ফল শুকনো খোলায় ভেজে খেলে পায়খানা বন্ধ হয়। জায়ফল ও শুঠ (শুকনা আদা) গাওয়া ঘিয়ে ঘষে চাটালে বাচ্চাদের সর্দির জন্যে যদি পেটের অসুখ করে তা সারবে। জায়ফলের চূর্ণ গুড়ে মিশিয়ে ছোট ছোট গুলি পাকিয়ে নিতে হবে । এই গুলি আধ ঘন্টা অন্তর খাওয়ালে এবং তার সঙ্গে একটু গরম জল খাওয়ালে কলেরার বা আন্ত্রিক রোগের পায়খানা (মল নিষ্কাশন) বন্ধ হয়। জায়ফলের এক দু ফোঁটা তেল বাতাসার বা চিনির সঙ্গে মিশিয়ে খেলে পেট ব্যথা ও গ্যাস সারে।

৫. কানের অসুখে: তেলের সঙ্গে মিশিয়ে কানে দিলে কানের বধিরতা (কান কালা)। হওয়া সারে।

৬. বমি ও হেঁচকি বন্ধ করে: জায়ফল ভাতের ফ্যানে ঘষে খাওয়ালে হেঁচকি ও বমিভাব সেরে যায়।

৭. পাতলা পায়খানা বন্ধ: জায়ফল, খারিক (কবিরাজি দোকানে পাওয়া যায়) আফিম সমপরিমাণ নিয়ে এবং পানের রসে বেটে ছোলার দানার আকারে গুলি তৈরি করতে হবে। এই হল আয়ুর্বেদের বিখ্যাত ‘জাতিফলাদি গুটিকা’। ঘোলের সঙ্গে এই গুলি খাওয়ালে সব রকমের দাস্ত (পায়খানা) বন্ধ হয়।

৮. অনিদ্রা দূর করে: একটা জায়ফলের এক চতুর্থাংশ গুঁড়া জলে মিশিয়ে খেলে ঘুম ভাল হয়। জায়ফল ঘষে তার প্রলেপ কপালে লাগালে ঘুম ভাল হয়।

৯. দাঁতের রোগ সারাতে: জায়ফলের তেলে ভেজানো তুলে দাঁতে রাখলে দাঁতের পোকা মরে যায় এবং দাঁতের ব্যথা কমে এবং পাইয়োরিয়া সেরে যায়।

১০. ব্রণ সারাতে: জায়ফলের তেল দিয়ে তৈরি করা মলম লাগালে ব্রণ ঘা ইত্যাদি তাড়াতাড়ি সেরে যায়।

জায়ফল খেলে মুখ সুগন্ধিত হয়। ঘামের দুর্গন্ধ নষ্ট হয়, বায়ু নিঃসারিত হয়ে যাওয়ার জন্যে বায়ুর আধিক্য কমে যায়। বমি বা গা বমি ভাব সারে, শৈত্যের জন্য মল ত্যাগ হতে থাকলে তা নিবারিত হয়।

হাকিমি মতে, জায়ফল মায়েদের স্তনের দুধ বাড়িয়ে দেয় অর্থাৎ শুন্যবর্ধক। কিন্তু বেশি মাত্রায় জায়ফল কখনোই খাওয়া উচিত নয়। বেশি জায়ফল খেলে লাভের বদলে ক্ষতিই হবে। জ্বর হলে, শরীরে দাহ থাকলে (শরীর জ্বালা করলে) এবং ব্লাডপ্রেসার (উচ্চ রক্তচাপ বেশি থাকলে জায়ফল খাওয়া বা ব্যবহার করা উচিত নয়।

তথ্যসূত্রঃ

১. সাধনা মুখোপাধ্যায়: সুস্থ থাকতে খাওয়া দাওয়ায় শাকসবজি মশলাপাতি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, নতুন সংস্করণ ২০০৯-২০১০, ২৫১-২৫৩

Leave a Reply