গোল মরিচ কালো গোল মরিচ (বৈজ্ঞানিক নাম: Piper nigrum) একটি লতানো উদ্ভিদ। এটি মসলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও প্রাচীনকাল থেকেই এদের আয়ুর্বেদিক ব্যবহার দেখা যায়। মরিচ প্রধানত কাজ করে রসবহস্রোতে এবং অগ্ন্যাশয়ে বা পচ্যমানাশয়ে। প্রতিদিনের রান্নায় গোলমরিচ ব্যবহার করা হয়। কাজে কাজেই এর তীক্ষ্ণ স্বাদের কথা সকলেরই জানা আছে । এই তীক স্বাদের জন্যেই হিন্দিভাষী গ্রামাঞ্চলের মানুষ একে ‘তীখে’ও বলেন। যাঁরা রান্নায় লঙ্কা খেতে চান না তাঁরা ব্যঞ্জন ঝাল করতে গোলমরিচ ব্যবহার করেন।
গোলমরিচ দু রকমের সাদা ও কালো। অর্ধ পক্ক দানাগুলো শুকিয়ে গেলেই কালো গোলমরিচ। গোলমরিচের দানা যখন পুরোপুরি পেকে যায় তখন ওপরের কালো খোসাটা ছাড়িয়ে দিলেই পাওয়া যায় সাদা গোলমরিচ। গুণপনার দিক থেকে সাদা গোলমরিচেরই মূল্য বেশি। অনেকে রান্নায় সাদা গোলমরিচ ব্যবহার করেন কারণ গোলমরিচের চূর্ণ মেশালে তা ব্যঞ্জনে কালো কালো দেখায়, প্রচ্ছন্ন থাকেনা, দেখতে ভালো লাগে না কিন্তু সাদা গোলমরিচের গুঁড়া ব্যঞ্জনে মিশে যায় অর্থাৎ প্রচ্ছন্ন থাকে, আলাদা করে বোঝা যায় না। সাদা গোলমরিচের অবশ্য কালো গোলমরিচের চেয়ে দাম বেশি। এখানে সুস্থ থাকতে প্রতিদিনের প্রয়োগে কালো গোলমরিচের কথাই বলা হবে। পরিচিতি জানার জন্য পড়ুন:
গোল মরিচ একটি ঔষধি গুণসম্পন্ন লতা
আয়ুর্বেদ মতে, কালো গোলমরিচ উষ্ণ, কটু, তীক্ষ্ণ, রুক্ষ, অগ্নিউদ্দীপক (খিদে বাড়িয়ে দেয়), রুচি বৃদ্ধি করে, কফ ও বায়ুনাশক। স্বাস, শূল, কফ, কৃমি ও হৃদরোগে উপকারী।
হাকিমি বা ইউলানি মতে, কফনাশক, স্মৃতিশক্তি বর্ধক, পেশী, স্নায়ুমণ্ডল, পাকস্থলী ও যকৃৎ (লিভার) সবল করে, টক ঢেকুর ওঠা (অম্নোদার) বন্ধ করে, কামোদ্দীপক, আগ্নেয় (খিদে বাড়িয়ে দেয়), ফোলা ও বায়ু দূর করে, রক্তশোধন করে, উষ্ণতা ও ক্ষুধা উৎপাদন করে, খাস, কাশি, প্রমেহ, বুকের ব্যথা এবং কফের জন্যে ব্রেনে যে অসুখ হয় সেগুলো উপশম করে।
চিকিৎসকদের মতে, গোলমরিচ উত্তেজক, পাচক (খাবার হজম করায়), বায়ুনাশক। ধন্বন্তরি গোলমরিচকে ‘জন্তসস্তাননাশনম্ অথাৎ ব্যাকটিরিয়া ভাইরাস ইত্যাদি নাশক বলেছেন। রাজনিঘন্টুকারের মতে, গোলমরিচ হৃদরোগ বা হার্টের অসুখ দূর করে।
ইউনানি মতে আরও বলা হয়েছে গোলমরিচ গ্যাস, বারবার ঢেকুর ওঠা ও উদরপীড়া (পেটের ব্যথা বা অসুখ) সারিয়ে দিয়ে কামোত্তেজনা বৃদ্ধি করে এবং মলকারক পুরনো জ্বর, দাঁতের ব্যথা, মাড়ি ফুলে যাওয়া, কটিবাত, প্লীহা বৃদ্ধি, পক্ষাঘাত, শ্বেতী, গলগণ্ড, চোখের অসুখ, মেয়েদের ঋতুস্রাব কম হওয়া প্রভৃতি অসুখের উপশম করে।
বৈজ্ঞানিকেরা বলেছে, গোলমরিচ উষ্ণ, অগ্নিদীপক, বাহর ও উত্তেজক। গোলমরিচ খেলে মুখে লালা বেশি সৃষ্টি হয়, ধমনীতে ক্ষিপ্রতা আনে, ত্বক, চকচকে হয় এবং পায়ু (মলদ্বার) মূত্রাশয় ও গর্ভাশয় ও জননেন্দ্রিয়ের ওপর উত্তেজক প্রভাব পড়ে।[১] নিম্নে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো।
১. কাসিতে: যে কাসিতে সর্দি উঠে যাওয়ার পর একটি উপশম হয়, অথবা জল খেয়ে বমি হয়ে গেলে যে কাসির উদ্বেগটা চলে যায়, বুঝতে হবে। এই কাসি আসছে অগ্ন্যাশয়ের বিকৃতি থেকে, যেটাকে আমরা সাধারণত বলে থাকি পেট গরমের কাসি। সেক্ষেত্রে গোলমরিচ গুঁড়ো করে, কাপড়ে ছেঁকে নিয়ে, সেই গুঁড়ো এক গ্রাম মাত্রায় নিয়ে একটু গাওয়া ঘি ও মধু মিশিয়ে, অথবা ঘি ও চিনি মিশিয়ে সকাল থেকে মাঝে মাঝে একটু একটু করে ৭ থেকে ৮ ঘন্টার মধ্যে ওটা চেটে খেতে হবে। এর দ্বারা ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যে ঐ পেট গরমের কাসিটা প্রশমিত হবে।
২. আমাশয়: এই আমাশয়ে আম বা মল বেশি পড়ে না। কিন্তু শুলুনি ও কোথানিতে বেশি কষ্ট দেয়; এক্ষেত্রে মরিচ চূর্ণ এক বা দেড় গ্রাম মাত্রায় সকালে ও বিকালে দু’বার জলসহ খেতে হবে। এর দ্বারা ঐ আমদোষ ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যেই চলে যাবে। এছাড়া জলে মিশিয়ে খেলে আমাশার উপশম হয়। গোলমরিচ, চিত্রক (রাং চিতা কবিরাজি দোকানে পাওয়া যায়) এবং কালো নুন একসঙ্গে মিশিয়ে মিহি করে মধু মিশিয়ে চাটলে এবং তারপরে টাটকা পাতা টক দইয়ের ঘোল খেলে বা ঘোলের সঙ্গেই এই সব পেষা মশলা মিশিয়ে খেলে পুরোনো আমাশা সেরে যায়।
৩. ক্ষীণ ধাতু: এখানে কিন্তু শুক্র সম্পর্কিত ধাতুর কথা বলা হচ্ছে না, এটা আমাদের সমগ্র শরীরে যে রস, রক্ত, মাংস, মেদ, অস্থি, মজ্জা ও শুক্র আছে সেই সপ্তধাতু সম্পর্কে বলা হচ্ছে।
খাওয়ার জন্য যে রসধাতু উৎপন্ন হয়, তারই কর্ম পরিণতিতেই আমাদের শরীরের অন্যান্য ধাতুগুলির পোষণ হয়; এখন এক ধাতু থেকে অন্য ধাতুতে রূপান্তরিত হতে গেলে যে অগ্নির প্রয়োজন হয়, সেইটি ধাতুগত অগ্নি। প্রতিটি ধাতুরই অগ্নিক্রিয়ার পৃথক সত্ত্বা আছে।
এখন দেখা যাচ্ছে সমগ্র শরীরের তথা ধাতুগুলির অগ্নি মন্দীভূত; যাকে বর্তমান যুগে বলা হয় মেটাবলিজিম কমে যাওয়া যার ফলে খাবার ভালোভাবে পরিপাক না হওয়াতে অপক্করসের জন্ম হয়, সেই রস অপক্ক অবস্থায় ধাত্বন্তরে অর্থাৎ পরবর্তী স্তর রক্তধাতুতে গিয়ে উপস্থিত হয়। এই যে দোষযুক্ত রস তার দ্বারা সকল ধাতুই অল্প বিস্তর দূষিত বা ক্ষীণপ্রাপ্ত হতে থাকে। এই যে ক্ষেত্র এখানের প্রয়োজন বিকৃত রসধাতুর অগ্নিবল বাড়ানো; আবার এই রসধাতুর অগ্নিবল অগ্ন্যাশয়ের মুখাপেক্ষী; তাই মরিচ এই ক্ষেত্রে উপযোগী। সেটির প্রয়োগ পদ্ধতি হলো ৩ গ্রাম গোলমরিচ একটু থেঁতো করে ন্যাকড়ায় পুটলি বেঁধে ১৪৪ মিলিলিটার দুধে আর ২২৮ মিলিলিটার জল অর্থাৎ প্রায় আধ পোয়া আর এক পোয়া, একসঙ্গে সিদ্ধ করে দুধটুকু অবশিষ্ট থাকতে নামিয়ে, পুটলিটি তুলে নিয়ে, সেই দুধ সকালে ও বিকালে খেতে দিতে হবে, তবে তাঁর হজম করার শক্তি বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মরিচের মাত্রা ৫ গ্রাম পর্যন্ত নেওয়া যায়।
৪. ভুক্তপাক: লোভও সামলানো যায় না, খেয়েও হজম হয় না, একটু তেল ঘি জাতীয় গুরুপাক কিছু খেলেই অম্বলের ঢেকুর, গলা বুক জ্বালা, তারপর বমি হলে স্বস্তি। যদি কোনো সময় এই ক্ষেত্র উপস্থিত হয়, তাহলে খাওয়ার পরই গোলমরিচের গুঁড়ো এক গ্রাম বা দেড় গ্রাম মাত্রায় জলসহ খেয়ে ফেলবেন, এর দ্বারা সেদিনটার মতো নিষ্কৃতি পাবেন; তবে রোজই অত্যাচার করবো আর রোজই মরিচ খাবো, এটা করলে চলবে না।
৫. নাসা রোগ: এই রোগের নামটি ছোট হলেও রোগটি কিন্তু এতটা লঘু নয়; এই রোগের মূল কারণ রসবহ স্রোতের বিকার, আর তার লীলা ক্ষেত্র হলো গলা থেকে উপরের দিকটায়। এর লক্ষণ হলো প্রথমে নাকে সর্দি, তারপর নাক বন্ধ, কোনো কোনো সময় কপালে যন্ত্রণা, ঘ্রাণশক্তির হ্রাস এবং দুর্গন্ধও বেরোয়, এমন কি আহারের রুচিও কমে যায়, কারও কারও ঘাড়ে যন্ত্রণা হতে শুরু করে, নাক দিয়ে রক্তও পড়ে এক্ষেত্রে পুরনো আখের গুড় ৫ গ্রাম, গরু দুধের দই ২৫ গ্রাম, তবে এই দই বাড়িতে পেতে নিলে ভাল হয়; তার সঙ্গে এক গ্রাম মরিচের গুঁড়ো মিশিয়ে সকালে ও বিকালে দু’বার খেতে হবে। এর দ্বারা ৩ থেকে ৪ দিন পর ঐ সব উপসর্গ কমতে শুরু করবে।
৬. ক্রিমি রোগে: অগ্ন্যাশয় বিকারগ্রস্ত, তারই পরিণতিতে রসবহ স্রোতের বিকার; এই দুটি বিকারের ফলে যে ক্রিমির জন্ম হবে, সেটার লক্ষণ হলো পেটের উপরের অংশটায় দু’ধারের পাঁজরের হাড়গুলির সংযোগস্থলের নিচেটায় মোচড়ানি ব্যথা, এটা ২ থেকে ৭ বা ৮ বৎসর বয়সের বালক বালিকাদেরই হয়। এই ক্রিমির কবলে পড়লে মাথাটা একটু হোড়ে বা বড় হতে থাকে, এদের মুখ দিয়ে জল ওঠে না, প্রায়ই যখন তখন পেটে ব্যথা ধরে এই ক্ষেত্রে বালক বালিকাদের জন্য ৫o মিলিগ্রাম মাত্রায় মরিচের গুঁড়োয় একটু দুধ মিশিয়ে খেতে দিতে হবে। দরকার হলে সকালে ও বিকালে ২ বার খেতে দিতে পারা যায়।
৭. শিশুদের ফুলো বা শোথে: ঠান্ডা হাওয়া লাগানো বা প্রস্রাবের উপর পড়ে থাকা, শীতকালে উপযুক্ত বস্ত্রের অভাবে যেসব শিশুর ফুলে যায়, সেখানে টাটকা মাখনের সঙ্গে ৫০ মিলিগ্রাম মরিচের গুঁড়ো মিশিয়ে রাখতে হবে, সেটা একটু একটু করে জিভ লাগিয়ে চাটিয়ে দিতে হবে।
৮. গনোরিয়া: এই রোগকে আয়ুর্বেদে বলা হয় ঔপসর্গিক মেহ। এই রোগে প্রস্রাবের সময় বা পরে অথবা অন্য সময়েও টিপলে একটি পাজের মতো বেরোয়, এক্ষেত্রে মরিচ চূর্ণ ৮০০ মিলিগ্রাম মাত্রায় দু’বেলা মধুসহ খেতে হবে। প্রথমে ২ থেকে ৩ দিন একবার করে খেলে ভাল হবে।
৯. মূত্রাবরোধ: প্রস্রাব একটু একটু হতে থাকে এবং থেমেও যায়।পূর্ব থেকে এদের হজমশক্তিও কমে গিয়েছে ধরে নিতে হবে। এরা গোলমরিচ ২ গ্রাম নিয়ে চন্দনের মতো বেটে একটু মিশ্রি বা চিনি দিয়ে সরবত করে খেতে হবে।
১০. ফিক ব্যথায়: কি কোমরে, কি পাঁজরে এবং কি ঘাড়ে ফিক ব্যথা ধরেছে, ঝাড় ফুকও করতে হবে না, আর মালিশও করতে হবে না, শুধু গোলমরিচের গুঁড়ো এক বা দেড় গ্রাম মাত্রায় গরম জলসহ সকালে ও বিকালে ব্যবহার করবেন, এটাতে ঐ ফিক ব্যথা ছেড়ে যাবে। তবে এটা বৈদ্যকের নথিভুক্ত করতে হলে বলতে হবে রসবহু স্রোত বিকারপ্রাপ্ত হয়ে শ্লেষ্মাধরা কলা ও মাংসধরা কলা এই দু’টিতে বিকার সৃষ্টি করে বায়ুকে রুদ্ধ করেছে, তাই এই ব্যথা।।
১১. ঢুলুনি রোগে: কথা কইতে কইতে মনের অগোচরে মাথা নেমে যাচ্ছে, চেষ্ঠা করেও সামলানো যাচ্ছে না, এক্ষেত্রে মুখের লালায় গোলমরিচ ঘষে চোখে কাজলের মতো লাগাতে হবে; এর দ্বারা ঐ ঢুলুনি রোগ সেরে যাবে। এটি একটি তান্ত্রিক যোগ।
১২. নিদ্রাহীনতায়: এই অনিদ্রা রোগ যাঁদের হয় সাধারণতঃ এরা একটু মেদস্বী বা মোটাকৃতির এরা মুলেখারার (Asteracantha longifolia) মূল শুকিয়ে নিয়ে তার ১০ গ্রাম ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে, সন্ধ্যেবেলা খেতে হবে। আর একটি গোলমরিচ নিজের মুখের লালায় ঘষে কাজলের মতো চোখে লাগালে তবে পুরো মরিচটা ঘষে নেওয়ার দরকার নেই; এর দ্বারা ঐ নিদ্রাহীনতা চলে যাবে। এটাও একটি তান্ত্রিক প্রক্রিয়া; দেখা যাচ্ছে রোগ ভেদে তার ক্রিয়া বিপরীতধর্মী হয়েছে।
১৩. বিষাক্ত পোকার জ্বালায়: বোলতা, ভীমরুল, কাঁকড়াবিছে, ডাঁস যেসব কীট পতঙ্গ কামড়ালে বা হুল ফোঁটালে জ্বালা করে, সেই জ্বালায় গোলমরিচ পানিতে ঘষে, তার সঙ্গে ২ থেকে ৫ ফোঁটা ভিনেগার মিশিয়ে ঐ হুলবিদ্ধ জায়গায় লাগালে জ্বালাটা কমে যাবে।
১৪. টাক রোগে: এ রোগ শুধু যে মাথায় হয় তা নয়; ভ্রু, গোঁফ প্রভৃতি যেখানেই লোমশ জায়গা, সেখানেই তার বসতি। সেক্ষেত্রে প্রথমে ছোট পেয়াজ যাকে আমরা চলতি কথায় ধানি পেয়াজ বলে থাকি; তার রস ঐ ব্যাধিতস্থানে লাগাতে হবে, তারপর ঐ জায়গায় গোলমরিচ ও সৈন্ধব লবণ একসঙ্গে বেটে ওখানে লাগিয়ে রাখতে হবে। ব্যবহারের কয়েকদিন বাদ থেকে ওখানে নতুন চুল গজাতে থাকবে।
১৫. চোখের অসুখ সারাতে : দুইয়ের সঙ্গে ঘষে চোখে জলের মতো পরলে রাতকানা রোগের প্রশমন হয়। এছারাও গোলমরিচ খাওয়া চোখের অসুখের পক্ষেও ভাল। চোখে কাজলের মতো দিতে পরলে ঝাপসা দেখা ও ছানিতে সুফল পাওয়া যায়। গোলমরিচ জল দিয়ে পিষে আঞ্জনীতে লাগালে আঞ্জনী তাড়াতাড়ি পেকে ফেটে যায়।
১৬. হেঁচকি বন্ধ করতে: একটা আস্ত গোলমরিচে ছুঁচ ফুটিয়ে পিদিমের শিখায় ধরলে যে ধোয়া বেরোবে তা শুকলে হেঁচকি ওঠা কমবে।
১৭. পেটের অসুখ সারাতে: পেট ফাঁপা, একটানা পেটের অসুখ বা পুরোনো পেটের অসুখে এবং পাকাশয়ের দুর্বলতায় গোলমরিচ খেলে উপকার পাওয়া যায়। মনক্কার (এক ধরনের বিচিসদ্ধ বড় কিসমিস) সঙ্গে গোলমরিচ চিবিয়ে খেলে মস্তিষ্কের ও পাকস্থলীর দূষিত বায়ু বিনষ্ট হয়। আদা আর লেবুর রসে অল্প গোলমরিচের গুঁড়ো মিশিয়ে খেলে পেট ব্যথা কমে।
১৮. পেটের বায়ু কমাতে: গোলমরিচ ও রসুন একসঙ্গে পিষে খাওয়ার প্রথম গ্রাসে যদি ঘি মিশিয়ে খাওয়া হয় তাহলে বায়ুর উপশম হয়। সঠিক মাত্রায় প্রতিদিন গোলমরিচ খেলে বায়ুর পীড়া কখনো হয় না। গোলমরিচের ক্বাথ তৈরি করে খেলে বা শুঁঠ গোলমরিচ, পিপুল ও হরীতকীর (হস্তুকি) চূর্ণ মধু মিশিয়ে চাটলে বদহজম ও গ্যাস দূর হয়।
১৯. দাঁতের ব্যথা সারাতে: দাঁতের ব্যথায় গোলমরিচের প্রলেপ উপকারী।
২০. মুখের ক্ষত সারাতে: গলায় ঘা বা ক্ষত হলে এবং আলজিভ বেড়ে গেলে গোলমরিচের ক্বাথ দিয়ে কুলকুচা করলে উপকার হবে।
২১. ডিসপেপসিয়ায়: হিং ও কপূর মিশিয়ে গােলমরিচ খেলে ডিসপেপসিয়ায় আরাম পাওয়া যায়।
২২. ফোঁড়া সারাতে: গোলমরিচ বেটে ফোড়ায় লাগালে উপকার পাওয়া যায় ।
২৩. সর্দি সারাতে: সর্দিতে শুঁঠ বা শুকনা আদা উপকারী। কিন্তু গোলমরিচ সাধারণ সর্দিতে আরও বেশি উপকার দেয়। যিনি রোগা এবং সর্দিতে ভুগছেন তিনি যদি দুধের সঙ্গে গোলমরিচ ফুটিয়ে পান করেন তাহলে শারীরিক ব্যাধি কমবে। গরম দুধে গোলমরিচ আর চিনি মিশিয়ে খেলে সর্দি সারে। গোলমরিচের গুড়া টাটকা টক দই ও গুড় মিশিয়ে প্রতিদিন খেলে অনেক দিন ধরে যে সর্দির রোগ চলছে সেই সর্দিতে বা পুরোনো সর্দিতে স্বস্তি পাওয়া যায়।
২৪. জ্বর সারাতে: জীর্ণ জ্বর অর্থাৎ পুরোনো জ্বরে গোলমরিচের ক্বাথ বিশেষ উপকারী। গোলমরিচ পিষে জলে মিশিয়ে ক্বাথ তৈরি করতে হবে। আঁচে ফুটে ফুটে যখন জল খুব অল্প থেকে যাবে তাতে চিনি মিশিয়ে খাওয়ালে জ্বর ছেড়ে যায়। চিরতার সঙ্গে গোলমরিচ মিশিয়ে খেলেও জ্বর ছাড়ে এবং আলস্য বা আলসেমি দূর হয়।
২৫. হজম বাড়াতে: গুরু ভোজন বা অতি ভোজনের পর তাড়াতাড়ি হজম করাবার জন্যে খাওয়ার সঙ্গে গোলমরিচ খেলে সূফল পাওয়া যায়। টাটকা পুদিনা পাতা, গোলমরিচ, সৈন্ধব লবণ, হিং, আঙুর, জিরে এই সব একসঙ্গে মিশিয়ে পিষে লেবুর রস মিশিয়ে চাটনি তৈরি করে খেলে মুখের অরুচি ও পেটের বায়ু দূর হয়ে গিয়ে আবার খাওয়ার ইচ্ছে জাগ্রত হবে এবং হজমশক্তিও ভাল হবে।
২৬. বাচ্চাদের খিদে বাড়াতে: বাচ্চাদের রোজ গোলমরিচের গুঁড়া ঘি আর চিনি মিশিয়ে চাটিয়ে দিলে তাদের খিদে বেশি পায় দুর্বলতা দূর হয়, বলিষ্ঠ হয়ে ওঠে এবং সর্দি সেরে যায়।
২৭. ম্যালেরিয়া সারাতে: গোলমরিচের গুঁড়া তুলসীপাতার রস ও মধু মিশিয়ে খেলে ম্যালেরিয়া সেরে যায়।
২৮. কলেরা সারাতে: গোলমরিচ ১/৪ চা চামচ, কপূর ১/২ চা চামচ। প্রথমে কপূর ও হিং মিশিয়ে নিতে হবে। তারপরে এই মিশ্রণে গোলমরিচ চূর্ণ দিয়ে ষোলটি গুলি (হোমিওপ্যাথিক গুলির মতো ছোট ছোট গুলি) তৈরি করতে হবে। অর্ধ ঘন্টা পর পর এক একটি করে এই গুলি খাওয়ালে বমি ও পায়খানা বন্ধ হয়ে যাবে। বলা হয়ে থাকে চার ছয় ঘণ্টার মধ্যে কলেরার কষ্ট কমবে। যদি কলেরা হওয়ার জন্যে হাত পায়ে ব্যথা হয় তাহলে পেঁয়াজের রস গোলমরিচ গুড়া মিশিয়ে মালিশ করলে উপকার পাওয়া যাবে।
২৯. আমবাত কমাতে: গোলমরিচের গুড়া ঘিয়ে মিশিয়ে চাটলে এবং গোলমরিচ বাটার প্রলেপ দিলে আমবাত কমে যায়।
৩০. চুলকানি সারাতে: গোলমরিচ ও গন্ধক (কবিরাজি দোকানে পাওয়া যাবে) মিহি করে পিষে ঘি দিয়ে ভাল করে মেড়ে নিয়ে গায়ে লাগালে এবং তারপরে রোদে গিয়ে বসলে চুলকুনি সেরে যায়।
এছারা ম্যালেরিয়া, মস্তিষ্কের সর্দি, টাকরার ক্ষত এবং কলেরা রোগে গোলমরিচের ব্যবহার আছে। গোলমরিচের গুঁড়া চিনি আর ঘি একসঙ্গে মিশিয়ে খেলে মাথা ঘোরার উপশম হয়। গোলমরিচের ক্বাথ খেলে কলেরার বমি, মলত্যাগ, পেটফাঁপা প্রভৃতি উপসর্গ কমে যায়। নুন ও গোলমরিচ চূর্ণ দিয়ে দাঁত মাজলে নানা রকম দাঁতের রোগে আরাম পাওয়া যায়। প্রতিদিন নিয়ম করে দু তিনটে গোলমরিচের দানা খেলে অনেক রকম অসুখের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। গোলমরিচ ও নুন একসঙ্গে মিশিয়ে খেলে বমি হওয়া কমে। গোলমরিচের গুড়া শুকলে খুব হাঁচি হয়।
মনে রাখতে হবে প্রতিদিন টাটকা গোলমরিচ পিষে ব্যবহার করলেই সুফল পাওয়া যাবে। আরও মনে রাখতে হবে অতিরিক্ত কিছুই ভাল নয়। গোলমরিচও মাত্রাধিক পরিমাণে খেলে শরীরের উপকার না করে ক্ষতিই করবে। কাজেই সঠিক পরিমাণে, অল্প পরিমাণে গোলমরিচ খেলেই সুফল পাওয়া যাবে ‘ধন্বন্তরির এই জন্তুনাশকের’।
রাসায়নিক গঠন:
(a) Alkaloids viz, piperettine, piperine, chavicine, piperidine, (b)Acids viz., piperinic acid, isopiperinic acid, chavicinic acid, isochavicinic acid. (c) Fatty alcohols, essential oil.[৪]
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. সাধনা মুখোপাধ্যায়: সুস্থ থাকতে খাওয়া দাওয়ায় শাকসবজি মশলাপাতি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, নতুন সংস্করণ ২০০৯-২০১০, ২২৭-২৩২।
২. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৪, পৃষ্ঠা, ১৬-২০।
৩. সাধনা মুখোপাধ্যায়: প্রাগুক্ত, পৃ. ২২৭-২৩২
৪. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬-২০