পৃথিবীর সভ্যতা শুরু হওয়ার সঙ্গে যে কয়টি মসলা ওষুধ হিসেবে গণ্য করা হতো, তার মধ্যে মৌরি অন্যতম। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সভ্যতায় মৌরি ব্যবহার হয়েছে বিশেষ করে প্রসূতি মায়ের দুধ বৃদ্ধি, শরীর শীতল রাখা ও শরীরের ওজন ঠিক রাখার জন্য।
মৌরি খনিজ লবণসমৃদ্ধ একটি বীজ। এতে প্রচুর পরিমাণে আছে কপার, আয়রন, পটাশিয়াম, সেলেনিয়াম, জিংক ও ম্যাগনেশিয়াম। এ ছাড়া ভিটামিন এ, সি, ই ছাড়াও একাধিক বি ভিটামিন থাকায় এর কদর বহুল অংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। তা ছাড়া মৌরি একটি আঁশসমৃদ্ধ মসলা, যাতে রয়েছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ফ্ল্যাভনয়েড নামের বিশেষ উপাদান। ফ্ল্যাভোনয়েডগুলো খাদ্যতালিকায় প্রধানত গ্লাইকোসাইড এবং পলিমার হিসেবে দেখা যায়, যা হজম ট্র্যাক্টের পরিবর্তনশীল এক্সটেন্টগুলোতে অবনমিত করে।
শরীর শীতল করে: আমাদের প্রাচীন চিকিৎসাব্যবস্থায় মৌরির অনেক গুণের কথা বলা হয়েছে; তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বলা হয়েছে শরীর শীতল রাখতে মৌরির কার্যকারিতা সম্পর্কে। যখন খুব গরম অনুভব করবেন তখন এক চা–চামচ পরিমাণ মৌরি ধীরে ধীরে চিবিয়ে খেতে হবে, এতে পেটের ভেতর জমে থাকা বায়ু বেরিয়ে যাবে, শরীর সঙ্গে সঙ্গে শীতল হয়ে যাবে। মৌরির সঙ্গে পেটের দারুণ ভালো সম্পর্ক। মৌরি পেটে গেলেই শরীর শীতল করার কাজ শুরু করে দেয়।
পেটের নানা সমস্যায়: মৌরি পেটের নানা সমস্যায় একটি অত্যন্ত কার্যকর ওষুধ। বিশেষ করে পেট ফাঁপা এবং ফাঁপাজনিত কারণে পেটে ব্যথা, পেটে কামড় দেওয়ার মতো অস্বস্তিতে খুব উপকারী। এক চা–চামচ মৌরি এক কাপ পানিতে জ্বাল দিয়ে আধা কাপ হলে তা নামিয়ে চায়ের মতো করে খেতে হবে এতে করে অস্বস্তি কমে যাবে। যাদের কোষ্টকাঠিন্যের কারণে পেটে ব্যথা হয় ও ফেঁপে থাকে, তারা প্রতি বেলা খাবারের পর এক কাপ একই উপায়ে মৌরি জ্বাল দেওয়া পানি পান করলে পেট পরিষ্কার হয়ে যায়। এটি একটি প্রাচীন ল্যাক্সিটিভ ড্রিংকস হিসেবে বহুল প্রচলিত।
হজমের গন্ডগোলে: মৌরি আমাদের মানবশরীরের অন্যতম প্রধান কাজ খাদ্য হজম প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে শরীরের খাদ্য উপাদানগুলো প্রয়োজনীয় স্থানে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করে। আমাদের সমাজে এখন নানা ধরনের খাবার একসঙ্গে খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এই প্রবণতা হজমশক্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। তাই সচেতনতা খুবই জরুরি এবং একসঙ্গে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, মিষ্টি খাবার পরিহার করতে পারলে ভালো। যারা এমন অবস্থায় প্রতিনিয়তই পড়ছেন বা খাচ্ছেন, তাদের জন্য এক চা–চামচ মৌরি এক কাপ পানিতে জ্বাল দিয়ে আধা কাপ হলে তা নামিয়ে চায়ের মতো করে খেতে হবে। এতে হজমের গন্ডগোল কমবে; কিন্তু খাদ্যগ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্ক না হলে কোনো ধরনের স্থায়ী সমাধান আশা করা যাবে না।
চোখের দৃষ্টিশক্তি মজবুত করতে: যাদের দৃষ্টিশক্তি দুর্বল, বিশেষ করে শিশুদের দেখা যায় চশমা পরতে। সেসব শিশুকে প্রতিদিন নিয়মিত এক চা–চামচ মৌরি এক কাপ পানিতে জ্বাল দিয়ে আধা কাপ হলে তা নামিয়ে চায়ের মতো করে খাওয়াতে হবে। এই পানীয় খেলে শিশুর হজমশক্তিও ঠিক হবে, সেই সঙ্গে দৃষ্টিশক্তির দুর্বলতা কেটে যাবে এবং চশমা ছাড়তে পারবে।
প্রসূতি মায়ের বুকে দুধ বাড়াতে: যেসব মা সদ্য সন্তান প্রসব করেছেন, তাঁদের প্রায়ই দেখা যায় শিশু বুকের দুধ পাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রাচীন পদ্ধতি মৌরি খেলে কাজ হবে। এ ক্ষেত্রে আধা চা–চামচ মৌরি চিবিয়েও খেতে পারেন অথবা এক চা–চামচ মৌরি এক কাপ পানিতে জ্বাল দিয়ে আধা কাপ হলে তা নামিয়ে চায়ের মতো করে খেতে পারেন। এতে করে বুকে দুধ বাড়বে।
কৃমিনাশক ও ক্লোন পরিষ্কারে: মৌরির ভেজানো পানি অথবা এক চা–চামচ মৌরি এক কাপ পানিতে জ্বাল দিয়ে আধা কাপ হলে তা নামিয়ে চায়ের মতো করে খেলে কৃমিনাশ হবে। এর ফাইবার পেট পরিষ্কারে সহায়তা করে, যাদের পেট ঠিকমতো পরিষ্কার হয় না, তারা খাবারের পর একটু মৌরি চিবিয়ে খেলে পেট পরিষ্কারে সহায়তা করবে।
শরীরে ব্যথা এবং জয়েন্ট পেইন: যাঁরা শরীরের নানা ধরনের ব্যথা নিয়ে থাকেন, বিশেষ করে হাঁটু, কোমরের জয়েন্টগুলোর ব্যথা সারতে চায় না। এ ক্ষেত্রে নিদান হিসেবে মৌরির জুড়ি নেই। এক বাটি শর্ষে তেলে একটু মেথি, এক টুকরা আদা, এক কোষ রসুন এবং এক চা–চামচ মৌরি দিয়ে তেলটা গরম করে আক্রান্ত স্থানে লাগিয়ে দিলে ব্যথা কমে আসবে আর সেই সঙ্গে এক চা–চামচ মৌরি এক কাপ পানিতে জ্বাল দিয়ে আধা কাপ হলে তা নামিয়ে চায়ের মতো করে খেলে শরীরের ব্যথা দূর হবে।
প্রাচীনকাল থেকেই মসলা আর মুখশুদ্ধি হিসেবে মৌরি ব্যবহার হয়ে আসছে। পানের সঙ্গে মৌরির একটি চমৎকার কম্বিনেশন হিসেবে কাজ করে। সুশ্রুত মৌরিকে কফনাশক হিসেবে গণ্য করেছেন। আমাদের আধুনিক সমাজে খাদ্যে অধিক তেল, লবণ, ঝাল ও মসলা যুক্ত হয়েছে, যা মানুষের শরীরে তাপের সৃষ্টি করে। এর ফলে আমাদের পেটের যাবতীয় সমস্যার উদ্ভব হতে থাকে। এ জন্যই পেটকে শীতল করা খুবই জরুরি। যেমন খাওয়ার পরে টকদই প্রোবায়োটিক হিসেবে কাজ করে, তেমনি মৌরি পেটকে শীতল রাখতে কাজ করে।
লেখক: খাদ্য, পথ্য ও আকুপ্রেশার বিশেষজ্ঞ।
প্রথম আলো লিংক: শরীরে শীতলতা আনে মৌরি