বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ৫ বছরের কম বয়সের শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ মেনিনজাইটিস। ২০১২ সালে, ভারত সরকার সারাদেশে ইউনিভার্সাল টিকাদান কর্মসূচিতে (UIP) পেন্টাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন প্রবর্তন করে। যদিও বর্তমানে মেনিনজাইটিসের প্রকোপ হ্রাস পেয়েছে, তবুও এটি প্রতিরোধে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।
মেনিনজাইটিস কী?
মেনিনজাইটিস হল মেরুদণ্ড এবং মস্তিষ্কের চারপাশে আচ্ছাদনকারী ঝিল্লি প্রদাহ। মূলত জীবাণুর সংক্রমণের কারণেই এই প্রদাহের সৃষ্টি হয়। শিশু, কিশোর এবং প্রাপ্তবয়স্ক সকলেরই মেনিনজাইটিস হতে পারে, যদিও মেনিনজাইটিসের ধরণটি বয়স অনুসারে পরিবর্তিত হয়। মেনিনজাইটিস বা মস্তিষ্কপর্দার প্রদাহ মস্তিস্ক বা সুষুম্নাকান্ডের আবরণকারী পর্দা বা মেনিনজেসের প্রদাহজনিত একটি রোগ। মেনিনজাইটিস একটি জরুরী অবস্থা, যেখানে দ্রুত চিকিৎসা অপরিহার্য।
মেনিনজাইটিসের বিভিন্ন প্রকার ও কারণ :
মেনিনজাইটিস ব্যাকটিরিয়া, ভাইরাস, ফাংগাস, প্রোটোজোয়ার ইত্যাদি কারণে হয়। মেনিনজাইটিসের সবচেয়ে সাধারণ ধরন হল ব্যাকটিরিয়া এবং ভাইরাস। তবে বিভিন্ন ধরনের ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় বা ক্যান্সারের কারণেও মেনিনজাইটিস হতে পারে।
ক) ভাইরাল মেনিনজাইটিস:
মেনিনজাইটিসের সবচেয়ে সাধারণ ধরন হল ভাইরাল মেনিনজাইটিস। এটি নিজে থেকে নিরাময় হয়। ব্যাকটেরিয়া জনিত মেনিনজাইটিসের চাইতে কম ভয়ংকর। ভাইরাল মেনিনজাইটিসের প্রধান জীবাণু এন্টেরোভাইরাস। এর বাইরেও কিছু ভাইরাস এই রোগের সৃষ্টি করে যা মশার মাধ্যমে একজনের কাছ থেকে অন্য জনের দেহে ছড়াতে পারে।
খ) ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিস: এই ধরনের মেনিনজাইটিস সংক্রামক। ব্যাকটিরিয়া মেনিনজাইটিস স্ট্র্যাপ্টোকোকাস নিউমোনিয়া, নাইসেরিয়া মেনিনজাইটিডিস, হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা, লিস্টেরিয়া মনোসাইটোজিনেসিস এবং স্টেফিলোকোকাস অরিয়াসের মতো নির্দিষ্ট ধরণের ব্যাকটিরিয়া দ্বারা সৃষ্ট হয়। যদি চিকিৎসা না করা হয়, তবে মারাত্মক অবস্থা হতে পারে। রিপোর্ট অনুযায়ী, ৫ থেকে ৪০ শতাংশ শিশু এবং ২০ থেকে ৫০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্করা বিভিন্ন ব্যাকটিরিয়ার সংক্রমণেই মারা যায়।
গ) ফাংগাল মেনিনজাইটিস: একটি বিরল ধরণের মেনিনজাইটিস, ফাংগাল মেনিনজাইটিস ক্রিপ্টোকোকাস, ব্লাস্টোমাইসেস, হিস্টোপ্লাজমা এবং কক্কিডায়োআইডেস ইমিটিসের মতো ছত্রাকজনিত কারণে ঘটে। ছত্রাকটি শরীরে সংক্রামিত হয় এবং রক্ত প্রবাহে ছড়িয়ে যায়, সেখান থেকে মস্তিষ্ক বা মেরুদণ্ডে যায়। রোগ প্রতিরোধকারী ক্ষমতা হ্রাসের ওষুধ সেবনকারী, এইডস/এইচআইভি আক্রান্ত রোগী ও বয়স্ক মানুষ ফাংগাল মেনিনজাইটিসের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
ঘ) প্যারাসাইটিক মেনিনজাইটিস: প্যারাসাইটিক মেনিনজাইটিস অ্যাঞ্জিওস্ট্রংগিলাস ক্যান্টোনেনসিস, গ্যান্থোসটোমা স্পিনিজেরাম, সিস্টোসোমার মতো পরজীবীদের কারণে ঘটে। প্যারাসাইটিক মেনিনজাইটিস সরাসরি সংক্রামক নয়, এটি একটি ব্যক্তির থেকে অন্য ব্যক্তির কাছে যায় না।
ঙ) জীবাণুবিহীন মেনিনজাইটিস: জীবাণুর বাইরেও কিছু কারণে মেনিনজাইটিস হতে পারে। শরীরে ক্যান্সারের বিস্তার, স্বয়ং-অনাক্রম্য ও কিছু বিশেষ ওষুধ সেবন করলে মেনিনজাইটিস হয়।
এই রোগের লক্ষণ :
এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলি কয়েকদিনের মধ্যেই বিকাশ লাভ করে। ভাইরাল এবং ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিসের লক্ষণগুলি শুরুতে একই রকম হতে পারে।এই রোগের লক্ষণগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হল। শিশুদের মধ্যে ভাইরাল মেনিনজাইটিসের লক্ষণগুলি হল- জ্বর, বিরক্তি ভাব, খিটখিটে মেজাজ, অতিরিক্ত ক্লান্তি, খেতে অনীহা, ত্বকে লাল লাল র্যাশ, নিদ্রাহীনতা ইত্যাদি। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ভাইরাল মেনিনজাইটিসের লক্ষণগুলি হল- জ্বর, বমি, মাথাব্যথা, ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া, হৃদরোগ, আলো ও শব্দ অসহনশীলতা, অতিরিক্ত ক্লান্তি, খেতে অনীহা, ত্বকে লাল লাল র্যাশ, নিদ্রাহীনতা ইত্যাদি। ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিসের লক্ষণগুলি হঠাৎ বিকাশ লাভ করে, সেগুলি হল- বমি, জ্বর, বিরক্তি ভাব, অতিরিক্ত ক্লান্তি, মাথাব্যথা, ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া, আলো ও শব্দ অসহনশীলতা, নিদ্রাহীনতা, ইত্যাদি। ফাংগাল মেনিনজাইটিসের লক্ষণগুলি হল- জ্বর, মাথাব্যথা, আলো ও শব্দ অসহনশীলতা, বমি, ইত্যাদি।
প্যারাসাইটিক মেনিনজাইটিসের লক্ষণগুলি ফাংগাল মেনিনজাইটিসের মতোই হয় এবং রোগীর শরীরে র্যাশ হতে পারে।
রোগনির্ণয় : চিকিৎসক বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষা এবং চিকিৎসার ইতিহাসের ভিত্তিতে এই রোগ নির্ণয় করেন। এছাড়াও, চিকিৎসক মেরুদণ্ডের পাশাপাশি মাথা, কান, গলা এবং ত্বকের চারপাশের সংক্রমণও পরীক্ষা করেন।
রোগনির্ণয়ের ক্ষেত্রে কম্পিউটারাইজড টোমোগ্রাফি (CT) এম আর আই(MRI), রক্ত পরীক্ষা, চেস্ট এক্স-রে ইত্যাদি পরীক্ষা করা হয়।
চিকিৎসা : এই রোগে দায়ী পরজীবি শনাক্ত করে সে অনুযায়ী ব্যাকটেরিয়া নিরোধক (অ্যান্টিবায়োটিক), ভাইরাস নিরোধক ( অ্যান্টিভাইরাল) অথবা ছত্রাক নিরোধক (অ্যান্টিফাঙ্গাল) ঔষধ ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও স্টেরয়েড এবং লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়।
রোগ-প্রতিরোধের উপায় :
মেনিনজাইটিস ছড়িয়ে পড়া রোধ করার কিছু উপায়- ক) ভালো করে হাত ধোয়া উচিত
খ) স্বাস্থ্যকর থাকুন
গ) কাশি বা হাঁচি দেওয়ার সময় মুখ ঢাকা রাখুন
ঘ) গর্ভবতী মহিলাদের খাওয়ার অভ্যাস সম্পর্কে অতিরিক্ত সতর্ক হওয়া উচিত
ঙ) এছাড়াও, টিকা গ্রহণের কারণে মেনিনজাইটিস প্রতিরোধ করা যেতে পারে।