জীবন থমকে গেছে শৈশবেই, কারুর আবার কৈশর ও যৌবনকালেই। সমাজে বাঁচতে চেয়েছিল তারাও। পারেনি জীবন যুদ্ধের লড়ইয়ে বেঁচে থাকতে। এই মারণ রোগ তিল তিল করে মেরেছে তাদের। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ এক ঘরে করেছে এই সমস্ত রোগীদের। কারণ, তারা এইডস রোগে আক্রান্ত। তাই তারা অচ্ছুত। এই সমস্ত কুসংস্কারকে দূর করতে এবং রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে প্রতিবছরের মত এবছরও ১ ডিসেম্বর পালিত হল ‘বিশ্ব এইডস দিবস’। ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন -এর পক্ষ থেকে এই রোগ প্রতিরোধের উদ্দ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৮৮ সাল থেকে পালিত হচ্ছে এই দিনটি। কিন্তু, আদতেই কি মানুষ সচেতন হচ্ছে রোগ সম্পর্কে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
‘ইউএন এইডস’- এর ২০১৮ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৩৭.৯ মিলিয়ন মানুষ HIV রোগে আক্রান্ত। মারা যান প্রায় ৭৭০০০০ জন মানুষ। নতুনভাবে, আক্রান্তের সংখ্যা ১.৭ মিলিয়ন। তবে, এই মাত্রাকে কমাতে ‘ইউএন এইডস’-এর পরিকল্পনা থমকে থাকেনি। HIV বা এইডস কি এইচআইভি (HIV) এক ধরনের ভাইরাস যার নাম হিউম্যান ইম্যুনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস। এইডস অর্থাৎ অ্যাকুয়ারড ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি সিন্ড্রোম যা এই HIV ভাইরাস থেকে সংক্রামিত হয়। এই রোগের দ্বারা আক্রান্ত মানুষকে এইচআইভি পজিটিভ (HIV+) বলা হয়। এই ভাইরাসের প্রধান কাজ, মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অকেজো করে ফেলা। এই ভাইরাস দেহের সবগুলো অঙ্গ ও তন্ত্রকেই ধীরে ধীরে অকেজো করে তোলে এবং শরীরে সমস্ত রোগের জন্ম নিতে সহায়তা করে।
রোগের কারণ দিন দিন এই রোগ মহামারির আকার ধারণ করছে। দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজকর্ম ও মেলামেশার মাধ্যমে, এমন কি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস, একই সাথে খাবার খাওয়ার মাধ্যমে, আবার শুধু যৌন মিলনের জন্য এই রোগের উৎপত্তি হয়, তা কিন্তু না। এছাড়াও, বিভিন্ন কারণের জন্যই দেখা দেয় এই রোগ।
যেমন –
১) অবাধ ও অবৈধ যৌন মিলন এবং অন্যান্য অস্বাভাবিক যৌন কর্মের দ্বারা ভাইরাসটি ছড়াতে পারে।
২) এই রোগে আক্রান্ত কোনও ব্যক্তির সঙ্গে যৌন মিলনে লিপ্ত হলে শরীরে এইচআইভি জীবাণু প্রবেশ করে।
৩) এই রোগে আক্রান্ত মায়ের থেকে গর্ভস্থ শিশু বা বুকের দুধ খাওয়ানোর মাধ্যমে শিশুর দেহে এই ভাইরাস প্রবেশ করে।
৪) বর্তমানে মাদকাসক্তি একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে, নেশার সময় একই সিরিঞ্জের মাধ্যমে একই সময়ে অনেকে মাদক গ্রহণের ফলে এই রোগ দেখা দিচ্ছে।
৫) এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত যদি কোনও সুস্থ মানুষের দেহে প্রবেশ করে, তবে আক্রান্ত হতে পারেন।
৬) এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তির দেহে প্রবেশ করা ইনজেকশনের সিরিঞ্জ , অস্ত্রোপচারের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সুস্থ ব্যক্তির দেহে ভুলবশত ব্যবহার হলে তা থেকে রোগ ছড়ায়।
৭) HIV আক্রান্তদের মাড়ির ক্ষত ও দেহের ক্ষত থেকে নিঃসৃত লালা ও রস থেকে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।
রোগের লক্ষণ
১) জ্বর, ১০ দিন বা তারও বেশি সময় ধরে জ্বর চলতে থাকে।
২) জিভে,ঠোঁটে,গলায় ও যৌনাঙ্গে ঘা হয়ে যাওয়া।
৩) শারীরিক দুর্বলতা দেখা দেওয়া।
৪) কোনও কিছু খাওয়ার সময় মুখে ও গলায় ব্যথা অনুভূত হওয়া।
৫) শুকনো কাশি চলতেই থাকে।
৬) সারা শরীরে রাত্রিকালীন ঘাম দেখা দেওয়া।
৭) শরীরের লিম্ফ নোড বা লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া।
৮) লাগাতার ডায়রিয়া চলতেই থাকে।
৯) শরীরের ওজন কমে যাওয়া।
১০) ধীরে ধীরে শরীরের অঙ্গ অকেজো হওয়া। রোগ নির্ণয় লক্ষণগুলির উপর ভিত্তি করে এবং HIV রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে রোগনির্ণয় করা হয়। এরপর বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে অঙ্গে সংক্রমণের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
চিকিৎসা
সাধারণত এইডসে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু অনিবার্য। কারণ, এর কোনও সঠিক চিকিৎসা নেই। তবে, কিছু কিছু ঔষধ আছে যা আক্রান্ত ব্যক্তিকে সাময়িকভাবে ভাল করে তুলতে সাহায্য করে।
১) ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং সঠিক চিকিৎসা করান।
২) উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি এআরটি-র সাহায্য নিন।
৩) আক্রান্ত রোগিকে এক ঘরে না করে দিয়ে পাশে থাকুন এবং মনের জোর বাড়ান।
৪) সময় মাফিক ঔষধ, জল ও স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে।
৫) এইচআইভি অক্রান্তদের দৈনন্দিন কাজকর্ম থেকে বঞ্চিত না করে কাজ করায় উৎসাহিত করতে হবে।
৬) প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে চললে এর ফল পাওয়া যাবে, বিশেষ করে খাদ্য পথ্য ও আকুপ্রেসার এই রোগের আরগ্য করতে সাহায্য করে।
প্রতিরোধের উপায়
১) সাধারণ মানুষের মধ্যে এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
২) শারীরিক মিলনের সময় কন্ডোম ব্যবহার করতে হবে।
৩) যৌন রোগের যথাযথ নির্ণয় ও চিকিৎসা করা খুবই জরুরি। যেকোনও যৌনরোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৪) রক্ত দেওয়া বা নেওয়ার সময় অথবা ইনজেকশনের সময়ে একটি সিরিঞ্জ একবারই ব্যবহার করুন।
৫) বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করান।
৬) গর্ভের প্রথম অবস্থায়ই মায়ের এইচআইভি পরীক্ষা করানো উচিত।
৭) খাদ্য নিয়ন্ত্রণ রেখে অধিক কাঁচা ফল সবজি নিয়মিত খাওয়া।
৮) নিয়মিত ব্যয়াম, আকুপ্রেসার করা।