বর্তমান সময়ে ঘরে বসে সময় কাটছে বেশির ভাগ মানুষের। ঘরের মধ্যে একটা বড় সঙ্গী হচ্ছে বিভিন্ন ডিভাইস—টেলিভিশন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল। চোখ থাকছে স্ক্রিনে। বিশেষ করে শিশুদের আরও বেশি সময় কাটছে এই ডিভাইসেই। এর কারণে চোখে চাপ পড়ছে। ফলে দৃষ্টিশক্তির ওপর মারাত্মক আঘাত হানছে; দৃষ্টিশক্তির কমবেশি সমস্যা ইতিমধ্যেই দেখা দিতে শুরু করেছে। এই অবস্থায় করণীয় কী? দৃষ্টিশক্তি ঠিক রাখার কিছু প্রাকৃতিক কৌশল আছে, তার মধ্যে আকুপ্রেশার অত্যন্ত কার্যকর।
প্রায় দেড় বছর ধরে শিশুরা বাড়িতে বসে থেকেছে। সারাক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকেছে। দূরের জিনিস দেখেনি। ফলে তাদের দূরের দৃষ্টিশক্তি ঠিকমতো তৈরিই হচ্ছে না। দৃষ্টিশক্তি এক দিনে তৈরি হয় না। আট বছর পর্যন্ত শিশুদের চোখের গঠনগত পরিবর্তন হতে থাকে। ফলে এই বয়সের শিশুরা দূরের জিনিস না দেখতে দেখতে, দূরের দৃষ্টিশক্তিই হারিয়ে ফেলছে। বড় হওয়ার পরও তাদের এই সমস্যা কাটবে না।
সমীক্ষা বলছে, বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষ কেবল কাছের জিনিস দেখতে পাওয়ার সমস্যায় ভুগবে। চোখের এই রোগকে মায়োপিয়া বলে। গত এক দশকে উন্নত দেশে এই সমস্যায় ভোগা রোগীর সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। কোভিডের সময়ে মায়োপিয়ার মতো সমস্যা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। বিশেষ করে ছোটদের চোখে এই সমস্যা সবচেয়ে প্রকট। চিকিৎসকেরা এর নাম দিয়েছেন কোয়ারেন্টিন মায়োপিয়া।
চীনে ১ লাখ ২০ হাজার শিশুকে পরীক্ষা করা হয়েছে। স্কুলপড়ুয়া এই শিশুদের চোখ পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ছয় থেকে আট বছরের শিশুদের মধ্যে মায়োপিয়া হওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। ২০১৯–এর তুলনায় ২০২০ সালে এই বয়সের শিশুদের চোখে মায়োপিয়া বৃদ্ধি পেয়েছে তিন গুণ।
পড়াশোনার সঙ্গে মায়োপিয়ার সরাসরি যোগ আছে। যাঁরা বেশি পড়াশোনা করেছেন, তাঁদের মায়োপিয়ার প্রবণতাও বেশি। মায়োপিয়ার হাত থেকে বাঁচার উপায় হলো, যেকোনো কাজ করার সময় মাঝেমধ্যেই একটু দূরের দিকে তাকানো। এটা অভ্যাস করে ফেলতে হবে। খুব মন দিয়ে মোবাইল বা ট্যাবলেটে কাজ করার সময়ও মাঝেমধ্যেই দূরের দিকে তাকাতে হবে। সূর্যের আলোও খুব জরুরি। দিনের কিছুটা সময় বাইরে কাটাতেই হবে। সূর্যের আলো আইবলের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। অন্ধকারে মায়োপিয়া বাড়ে। আলো থাকলে মায়োপিয়ার সমস্যা অনেক কমে যায়। এমন অবস্থায় আকুপ্রেশার করা জরুরি।
কীভাবে আকুপ্রেশার করবেন
বাচ্চাদের বেলায় নিজে নিজে না করতে পারলেও বাবা–মাকে বাচ্চার চোখের আকুপ্রেশার করে দিতে হবে। চোখের আকুপ্রেশার শুরুর প্রথমে চোখের চারপাশে যেখানটায় হাড় থাকে, ঠিক হাড়ের চারপাশে আস্তে আস্তে করে বুড়ো আঙুল দিয়ে ম্যাসাজ করতে হবে। প্রথমে দুই মিনিট ঘড়ির কাঁটার মতো, পরে দুই মিনিট ঘড়ির কাঁটার বিপরীতমুখী।
তারপর আমাদের ব্রেনের পয়েন্টে ১০০ বার করে দুই হাতের বুড়ো আঙুলে আকুপ্রেশার করতে হবে, চাপ এমনভাবে হবে, যাতে খুব জোরেও না আবার খুব আস্তেও না। ধীরে ধীরে দুইবার দুই হাতে আকুপ্রেশার করুন।
স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে শুধু মায়োপিয়ার সমস্যাই হয় না, এর ফলে শিশুদের চোখের জল শুকিয়ে যেতে থাকে, যাকে ড্রাই আই বলা হয়। চোখকে ক্লান্ত করে দেয় স্ক্রিন। স্মার্টফোনের নীল আলোর দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এর জন্য এই আকুপ্রেশার করলে আরাম দেবে।
তারপর চোখের মূল পয়েন্ট, যা আামদের ইনডেক্স ও মধ্যমা নিচের দিকে ভেতরের দিকে একটু সাইডে দুই আঙুলের ভেতরের দিকে পয়েন্টটা থাকে, ওখানে চাপ দিয়ে ধরলে অনেকেই ব্যথা অনুভব করবেন। ছবিতে দেওয়া পয়েন্টে নিয়মিত দুই হাতের দুই আঙুলেই ১০০ বার করে চাপ দিন।
যাঁদের সাইনাসজনিত সমস্যা আছে, তাঁদের চোখের পয়েন্টের সঙ্গে সাইনাস পয়েন্ট, ছবিতে দেখিয়ে দেওয়া আঙুলের উপরিভাগে প্রতিটি আঙুলেই কমপক্ষে ৫০ বার করে চাপ দিতে হবে। এতে সাইনাসও ভালো হবে। দৃষ্টিশক্তির জন্যও উপকার হবে।
নীল আলো ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়, অবশ্য বহু স্মার্টফোনই ব্লু লাইট রিডাকশনের ব্যবস্থা থাকে। নাইট মোড থাকে। তা সত্ত্বেও ঘুমের অন্তত দুই ঘণ্টা আগে ফোন বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কোনো স্ক্রিনের দিকে না তাকানোই ভালো।
চোখ ভালো রাখার খাবার গ্রহণ করা উচিত। এ জন্য কাঁচা সবজির সালাদ নিয়মিত খাওয়া উচিত। বিশেষ করে গাজর, বিট, টমেটো, ক্যাপসিকাম, শসা ও মিষ্টিকুমড়া সঙ্গে সবুজ পাতা, যেমন পালং, কলমি, বেথো অনেক উপকারী।
শিশুদের হাতে ইলেকট্রনিক ডিভাইস দেওয়া বন্ধ করা উচিত। বিশেষ করে তিন বছর বয়স পর্যন্ত যেকোনো স্ক্রিন শিশুদের চোখের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর। চার থেকে ছয় বছরের শিশুদের দিনে ৩০ মিনিটের বেশি স্ক্রিনের দিকে তাকানো ঠিক নয়। কিন্তু বিশেষ করে করোনাকালে সেই হিসাব সম্পূর্ণ বদলে গেছে। অনলাইনে ক্লাস করতে গিয়ে শিশুদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। এর থেকে নিস্তার পাওয়ার একটাই সুযোগ। সুযোগ পেলেই বাইরে যাওয়া। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে দূরের দিকে তাকানো। আর নিয়মিত আকুপ্রেশার করা।
লেখক: খাদ্য, পথ্য ও আকুপ্রেশার বিশেষজ্ঞ।