মানসিক সুস্থতা ও সুস্থ ভাবাবেগ আমাদের সার্বিক সুস্থতার এক গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি। শারীরিক সুস্থতার জন্যে আমরা অনেক কিছু করি – জিম যাই, হাঁটতে বেরোই, সাঁতার কাটি বা অন্যান্য খেলাধুলা করি।ঠিক একই রকম ভাবে, আমরা সুস্থ ভাবাবেগ ও মানসিকতার অধিকারী হবারও চেষ্টা করতে পারি।
একটি প্রচলিত ভুল ধারণা হল, যে কোনও মানসিক রোগ নেই মানেই সেই ব্যক্তি মানসিক ভাবে সুস্থ। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা এই ধারনাটির সাথে একমত নন।
সুস্থ ভাবাবেগ কেন জরুরি?
মানসিক আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা ও তার ভারসাম্য বজায় রাখা সহজ কাজ না। কারণ এই বিদ্যা রপ্ত না হলে জীবনে বিভিন্ন দুঃখ-কষ্ট, ব্যক্তিগত সম্পর্কে সমস্যা, ও অন্যান্য মানসিক ব্যধির উদয় হতে পারে। সুস্থ ভাবাবেগ ও মনের অধিকারী হলে আমরা নিশ্চিন্তে যে কোনও প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে পারি। তাছাড়া এর ফলে আমরা দৈননিন জীবনে আরও কর্মঠ হয়ে উঠতে পারি। একজন মানসিক সুস্থ ব্যক্তি নিজের সাথে ও অন্যের সাথে আরও ভাল সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হন, আর যে কোনও বাঁধা কাটিয়ে জীবনে এগিয়ে চলতে পারেন।
একজন কাউন্সেলর মতে, “আমাদের বিভিন্ন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। অপছন্দের পরিস্থিতি ও লোকেদের মাঝে বাস করতে হয়। আমরা সেই সমস্ত পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করি। অথচ তার বদলে আমাদের চারিপাশের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিকে পাল্টে ফেলা কিন্তু অনেক বেশি সহজ। এই পরিস্থিতিগুলো অনুযায়ী যত নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারব, ততই মানসিক সুস্থতার পথে এক ধাপ এগিয়ে যাব।”
মনের যত্ন নিন
কথাটা কি খুব খাপছাড়া ও কঠিন লাগল? বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে দৈনন্দিন জীবনে সামান্য পরিবর্তন আনলেই কিন্তু এই কাজটা খুব সহজ হয়ে উঠবে। আপনি সেই জন্যে নিচে লেখা পরামর্শগুলি মেনে দেখতে পারেন:
১. শরীরের যত্ন নিন
শারীরিক সুস্থতার সাথে মানসিক সুস্থতার নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। এর জন্যে আপনি পুষ্টিকর খাবার খান, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন, নিয়মিত ব্যায়াম করুন, এবং শরীরের যত্ন নিন। এর ফলে আপনার শরীর রোজকার ধকলের সাথে যুঝে উঠতে পারবে। ভিটামিন বি-১২ ও ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার আপনার মস্তিষ্কের আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী হরমোনগুলিকে চাঙ্গা রাখতে সাহায্য করে। পর্যাপ্ত বিশ্রামও খুবই প্রয়োজনীয়; কারণ ঘুমের সময় আমাদের শরীর সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলিকে সারিয়ে তোলে। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে আপনি ক্লান্ত ও খিটখিটে হয়ে পড়বেন। নিয়মিত ব্যায়াম আপনার খিদে বাড়াতে সাহায্য করবে; ফলে আপনার ভাল ঘুম হবে, এবং সব মিলিয়ে আপনি মানসিক ভাবে সুস্থ থাকবেন।
২. ব্যায়াম করুন, ফুসফুসে টাটকা বাতাস ভরুন
সূর্যের আলো আমাদের শরীরে সেরটিনিন নামে একটি রাসায়নিকের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। এই সেরিটিনিন আমাদের মস্তিষ্ককে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। ফলে সূর্যের আলোয় আমাদের মন ভাল হয়ে যায়। কায়িক পরিশ্রমও সুস্থ মনের জন্যে জরুরি। ব্যায়ামের ফলে শরীরে স্ফূর্তি আসে, ক্লান্তি ও মানসিক চাপ হ্রাস পায়। মনকে চাঙ্গা রাখতে নিজের পছন্দের কোনও কাজ করুন।
৩. নিজের যত্ন নিন
মানসিক সুস্থতা ও সুস্থ ভাবাবেগ পেতে নিজের যত্ন নেওয়া দরকার। মনের মধ্যে আবেগ চেপে রাখবেন না। অবদমিত আবেগ প্রকাশের ফলে মানসিক চাপ ও জটিলতা কমে যায়। নিজের জন্যে কিছুটা সময় আলাদা রাখুন; নিজের মনের কথা শুনুন, বই পড়ুন, ব্যক্তিগত শখ-আহ্লাদ মেটান, বা এমনি হাত-পা ছড়িয়ে সব কাজ ভুলে একটু আরাম করুন।
মনোযোগ বাড়াতে সব যন্ত্রপাতি দূরে সরিয়ে নিজের আশেপাশের দুনিয়াটাকে উপলব্ধি করুন। নিমহ্যান্সের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির অধ্যাপক ডাঃ এম মঞ্জুলার কথা অনুযায়ী, “ভূত ও ভবিষ্যৎ ভুলে বর্তমানে থাকার নামই মনোযোগ। খামখেয়ালের স্রোতে না ভেসে গিয়ে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী চিন্তায় সাড়া দেওয়া; একবারে একটি কাজেই মন দেওয়া, পরের ছিদ্রান্বেষণ না করে যে কোনও পরিস্থিতিতে স্থির ও অবিচল থাকার নামই মনোযোগ। এর ফলে আপনি চারপাশে থেকে আরও বেশি অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবেন যা আপনাকে যে কোনও অবস্থায় মাথা ঠাণ্ডা রাখতে সাহায্য করবে।”
৪. পছন্দের লোকজনের সাথে সময় কাটান
পছন্দের লোকের সাথে সময় কাটালে নিজের প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জন্মায়। বন্ধুবান্ধব, পরিবার, সহকর্মী এবং প্রতিবেশীদের সাথে ভাল সম্পর্ক বজায় রাখুন। এর ফলে আপনি সবার সাথে নিজেকে যুক্ত অনুভব করবেন। সহকর্মীদের সাথে একদিন খেতে যান, বা অনেকদিন বাদে কোনও পুরানো বন্ধুর সাথে দেখা করুন। একটি মিষ্টি হাসি ও স্নেহের আলিঙ্গনের বিকল্প কোনও প্রযুক্তি হতে পারে না।
৫. কোনও শখ গড়ে তুলুন বা নতুন কিছু করুন
পছন্দ অনুযায়ী কাজ করলে পরে মনও ভাল থাকে। এর ফলে মাথায় দুশ্চিন্তা আসে না এবং অবদমিত আবেগগুলিও প্রকাশ পায়। তাছাড়া শখের কাজকর্ম করলে আত্মবিশ্বাসও বৃদ্ধি পায়।
নতুন কাজের সঙ্গে যুক্ত হলে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিও তৈরি হয়, ফলে বাইরের জগতে আপনি নিজেকে আত্মবিশ্বাসের সাথে মেলে ধরতে শেখেন। নতুন জিনিস শিখলে মনের একঘেয়ে চিন্তা কেটে যায়, মনঃসংযোগ বাড়ে, এবং নতুন কিছু শেখার আনন্দে মন ভাল থাকে।
৬. দুশ্চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন
আমাদের সবারই বিভিন্ন লোকজন বা পরিস্থিতির কারণে দুশ্চিন্তা হয়। এই কারণগুলিকে প্রথমে চিহ্নিত করুন, তারপর সেগুলির উপর পুনরায় বিচার করুন। আপনি সেগুলি থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতে পারেন, যদি তা সম্ভব হয়। অনেক সময় সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আপনি সেই ব্যক্তিদের বা পরিস্থিগুলিকে সামলাতে পারেন না। এই জন্যেই স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট শেখা জরুরি।
“আপনি যদি পরীক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগেন, তবে পরীক্ষার প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। পরীক্ষা আপনার জীবনের মাপকাঠি না, সেটা সাময়িক এবং আবশ্যিক। কিছু ক্ষেত্রে আপনি দুশ্চিন্তার উৎসগুলিকে এড়িয়ে চলতে পারেন, কিন্তু আপনাকে এটাও বুঝতে হবে যে সবসময়ে তা সম্ভব না। কাজেই আপনাকে নিজেই দুশ্চিন্তাকে সামাল দেওয়ার কোনও পন্থা খুঁজে বের করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ আপনি কোনও বন্ধুর সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করতে পারেন, ধৈর্য ধরে নিজের উপরে বিশ্বাস রাখতে পারেন, পরিস্থিতিকে পুনরায় ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করতে পারেন, প্রাণায়াম করতে পারেন, একটু হাঁটতে যেতে পারেন, গান শুনতে পারেন, ব্যায়াম করতে পারেন, ইত্যাদি।”
৭. নিজের উপরে ভরসা হারাবেন না
আমরা সকলেই আলাদা, এবং আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই নিজস্ব ক্ষমতা এবং দুর্বলতা ররেছে। নিজের দুর্বলতাকে মেনে নিয়ে নিজের ক্ষমতার উপরে ভরসা রাখলে জীবনে এগিয়ে চলার সাহস পাওয়া যায়। সবারই কোনও না কোনও দুর্বলতা থাকে, আপনারও আছে; কেউই নিখুঁত নয়। আপনি নিজের দুর্বলতাকে দূর করার প্রয়াস করতে পারেন, অথবা সেগুলোকে নীরবে মেনে নিতে পারেন। আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মত আপনিও নিখুঁত নন, এটা মেনে নেওয়াটাই কিন্তু সুস্থ মানসিকতার পরিচয়। নিজের ক্ষমতা বুঝে বাস্তবসম্মত লক্ষ্য তৈরি করুন। সর্বপরি না বলতে শিখুন। এটা কোনও অন্যায় নয়।
৮. আশির্বাদ কুড়োন
একঘেয়ে শোনালেও এটা সত্যি যে, যা পেয়েছেন তা নিয়ে কৃতজ্ঞ হলে, যা পাননি তাই নিয়ে কষ্ট কমে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে এর ফলে মনের মধ্যে ইতিবাচক মানসিকতা জন্ম নেয়। একটি কৃতজ্ঞতা খাতা বানান। প্রত্যেকদিন রাত্রে শোবার আগে লিখে ফেলুন যে, আপনি আজ কেন ও কিসের জন্য কৃতজ্ঞ। নিজের মধ্যে কৃতজ্ঞতাবোধ জাগিয়ে তুললে, সবার আশীর্বাদ মনে রাখলে,দেখবেন প্রত্যেকদিনই আপনার কৃতজ্ঞতার কারণের অভাব হচ্ছে না।
৯. নিজেকে মেলে ধরুন
অনেক সময়ই আমরা নিজের আবেগ মেলে ধরতে লজ্জা পাই। নিজের মনোভাব মেলে ধরতে পারা, মনকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। অনেকেই নিজের ইচ্ছা বা ভাবনা চেপে রাখেন, যা খুবই ক্ষতিকর। এর ফলে সেই মানসিকতা আরও বেড়ে যায়। ফলে দুশ্চিন্তাও পাল্লা দিয়ে বাড়ে। ফলে অন্য কোনও দিকে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
আবেগ চেপে রাখার ফলে গুরুতর রকম ডিপ্রেশন আর অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার দেখা দিতে পারে। সামান্য রাগ বা দুঃখও চেপে রাখা উচিত নয়। শুধু জানতে হবে যে সবদিক বজায় রেখে আবেগের বহিঃপ্রকাশের উপায় কী। ডাঃ মঞ্জুলা বলেন, “কোন আবেগই, মূলত, ভাল বা খারাপ নয়। সমস্ত আবেগই প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ। সেই আবেগের মাত্রা ও বহিঃপ্রকাশের ধরণের উপর নির্ভর করে এই ভাল বা খারাপ হওয়া নির্ভর করে।”
১০. সাহায্য চান
এই দুনিয়াতে আক্ষরিক অর্থে সুখী ও নিশ্চিন্ত জীবন কেউ কাটান না। কাজেই মন খারাপ হলে, বিপদে পড়লে, হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়লে, বিচলিত হলে, রেগে গেলে, অথবা পরিস্থিতির সাথে খাপ না খাওয়াতে পারলে, বিশ্বাসযোগ্য কোনও ব্যক্তি যেমন – আপনার জীবনসঙ্গী, বন্ধু, অভিভাবক, ভাই-বোন বা আত্মীয়ের সাথে কথা বলুন। তাতেও না হলে একজন কাউন্সেলরের পরামর্শ নিন। দেরি করবেন না। এতে লজ্জার কিছুই নেই; বরং একে আশার আলো হিসেবে দেখুন। জীবনের বাঁধা বিপত্তিতে একলা চলতে হবে না। প্রাণোচ্ছল জীবনের এটাই একমাত্র রাস্তা।