ভিটামিন বি আসলে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স। অনেকগুলো ভিটামিনের যৌগ। এখানে প্রতিটিরই রয়েছে পৃথক কার্যকারিতা।
আমাদের শরীরের জন্য যে কয়টি ভিটামিন প্রতিদিন প্রয়োজন, তার মধ্যে ভিটামিন বি–এর প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। ভিটামিন বি হচ্ছে একটি যৌগ; এটা পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিনগুলোর একটি শ্রেণি, যা কোষে বিপাকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদিও এই ভিটামিনগুলোকে আটটি নামে ভাগ করা হয়েছে; এর প্রতিটি রাসায়নিকভাবে স্বতন্ত্র বা আলাদা। এগুলো যৌগিক হয়ে বিভিন্ন খাবার থেকে সংগৃহীত হয়ে শরীরকে ঠিক রাখে। সাধারণভাবে আটটি খাদ্য পরিপূরককে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পৃথক ভিটামিন বি–এর পরিপূরকগুলো প্রতিটি ভিটামিনের নির্দিষ্ট নম্বর বা নাম আছে, যেমন বি–ওয়ান থায়ামিন, বি–টু রিবোফ্লাভিন, বি৩ নিয়াসিন ইত্যাদি; কিছু আবার সংখ্যার চেয়ে নামে সুপরিচিত: নিয়াসিন, প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড, বায়োটিন ও ফলিক অ্যাসিড।
ভিটামিন বি মূলত বিপাক প্রক্রিয়ার একটি কোফ্যাক্টর (কোএনজাইম)। এর ঘাটতি হলে অনেক শারীরিক সমস্যা হয়। ঘাটতি পূরণে সেই সব সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
• ভিটামিন বি–ওয়ান থায়ামিন: স্নায়ুতন্ত্রের রোগের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে ওজন হ্রাস, সংবেদনশীল ব্যাঘাত, ওয়ার্নিকে এনসেফালোপ্যাথি (প্রতিবন্ধী সংবেদনশীল ধারণা), শারীরিক দুর্বলতা ও ব্যথা, অনিয়মিত হার্টবিট ও এডেমা (শরীরের টিস্যুর ফোলা ভাব)। বেশি ঘাটতি হলে হৃদ্রোগ এবং মৃত্যু হতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী থায়ামিনের ঘাটতি অ্যালকোহলীয় কর্সাকফ সিনড্রোমও হতে পারে, যা একটি অপরিবর্তনীয় ডিমেনশিয়া যা অ্যামনেসিয়া।
• ভিটামিন বি–টু রিবোফ্লাভিন: রিবোফ্লাভিনের ঘাটতি অ্যারিবোফ্লাভিনোসিস সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে চিলোসিস (ঠোঁটের ফাটল), সূর্যের আলোতে উচ্চ সংবেদনশীলতা, কৌণিক চাইলাইটিস, গ্লসাইটিস (জিহ্বার প্রদাহ), সেবোরিহিক ডার্মাটাইটিস বা সিউডো সিফিলিস, ফ্যারিঞ্জাইটিস (গলাব্যথা), হাইফেরেমিয়া এবং ফ্যারেঞ্জিয়াল ও ওরাল মিউকোসার এডেমা।
• ভিটামিন বি–থ্রি নিয়াসিন: (নিকোটিনিক অ্যাসিড), নিকোটিনামাইড, নিকোটিনামাইড রাইবোসাইড এনএডি ও এনএডিপি নামক কোএনজাইমগুলো, যা বিপাক প্রক্রিয়ায় প্রয়োজন। নিয়াসিনের অভাব হলে ট্রিপটোফেন, এটি মারাত্মক অপুষ্টি রোগ। এর লক্ষণগুলোর মধ্যে আছে ডার্মাটাইটিস, অনিদ্রা, দুর্বলতা, মানসিক বিভ্রান্তি ও ডায়রিয়া। পরিস্থিতি জটিল হলে পেলাগ্রা ডিমেনশিয়া এবং মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
• ভিটামিন বি–ফাইভ প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড: প্যান্টোথেনিক অ্যাসিডঅভাবজনিত কারণে ব্রণ এবং পেরেথেসিয়া হতে পারে, যদিও এটি অস্বাভাবিক।
• ভিটামিন বি–সিক্স পাইরিডক্সিন: পাইরিডক্সাল, পাইরিডক্সামাইন ভিটামিন বি৬–এর ঘাটতির কারণে সেবোরিক ডার্মাটাইটিসের মতো ফেটে যায়, গোলাপি চোখ এবং স্নায়বিক লক্ষণগুলো (যেমন মৃগীরোগ)।
• ভিটামিন বি–সেভেন: বায়োটিন ফ্যাটিঅ্যাসিডগুলোর সংশ্লেষণের জন্য এবং গ্লুকোনোজেনেসিসে প্রয়োজনীয় কার্বক্সিলাস এনজাইমগুলোর একটি কোএনজাইম। বায়োটিন ঘাটতি সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে লক্ষণ সৃষ্টি করে না; তবে শিশুদের প্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায় এবং স্নায়বিক রোগ হতে পারে। একাধিক কার্বোক্সিলাসের ঘাটতি, বিপাকের একটি জন্মগত ত্রুটি, ডায়েটরি বায়োটিন গ্রহণ স্বাভাবিক থাকলেও বায়োটিনের ঘাটতি হতে পারে।
• ভিটামিন বি–নাইন ফলিক অ্যাসিড: ডিএনএ তৈরি, মেরামতের জন্য প্রয়োজন। এটি একটি কো-ফ্যাক্টর; শৈশব এবং গর্ভাবস্থার মতো দ্রুত কোষ বিভাজন এবং বৃদ্ধিতে সহায়তা করার ক্ষেত্রে বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ। ফলিক অ্যাসিড ডেফিসিয়েন্সির ফলাফল ম্যাক্রোসিটিক রক্তাল্পতা এবং হোমোসিস্টিন। গর্ভবতী নারীদের শরীরে এর অভাব হলে জন্মত্রুটি নিয়ে শিশু জন্ম হতে পারে।
• ভিটামিন বি–টেন বিভিন্ন কোবালামিন; সাধারণত সায়ানোকোবালামিন বা ভিটামিন পরিপূরকগুলোতে মিথাইলকোবালামিন একটি কোএনজাইম, যা মানবদেহের প্রতিটি কোষের বিপাকের সঙ্গে জড়িত; বিশেষত ডিএনএ সংশ্লেষণ এবং নিয়ন্ত্রণকে প্রভাবিত করার পাশাপাশি ফ্যাটি অ্যাসিড ও অ্যামিনো অ্যাসিড বিপাককেও প্রভাবিত করে। কোবালামিনের অভাবের ফলে ম্যাক্রোসিটিক রক্তাল্পতা, এলিভেটেড মেথাইলামোনোনিক অ্যাসিড ও হোমোসিস্টাইন, পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি, স্মৃতিশক্তি হ্রাস এবং অন্যান্য জ্ঞানীয় ঘাটতি দেখা দেয়। বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে এটি হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, কারণ অন্ত্রের মাধ্যমে শোষণ বয়সের সঙ্গে হ্রাস পায়; অটোইমিউন রোগ ক্ষতিকারক রক্তাল্পতা অন্য একটি সাধারণ কারণ। এটি ম্যানিয়া ও সাইকোসিসের লক্ষণও তৈরি করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে পক্ষাঘাত দেখা দিতে পারে।
ভিটামিন বি মাংস, দুধ, পনির, দই, ডিম, মাছ, ঝিনুক, পালংশাক, বিট, মাশরুম, অ্যাভোকাডো, মটরশুঁটি, কিডনি বিন, ছোলা বাদাম, তরমুজ, সয়া পণ্য যেমন সয়া দুধে পাওয়া যায়। এগুলো কার্বোহাইড্রেট–ভিত্তিক খাবারগুলোতে অল্প পরিমাণেও পাওয়া যায়। প্রক্রিয়াজাত কার্বোহাইড্রেট যেমন চিনি এবং সাদা আটাতে তুলনামূলক কম বি ভিটামিন থাকে।
এ জন্য বহু দেশে (যুক্তরাষ্ট্রসহ) আইন অনুসারে প্রয়োজনীয় যে বি ভিটামিন থিয়ামিন, রাইবোফ্লাভিন, নিয়াসিন ও ফলিক অ্যাসিড প্রসেসিংয়ের পরে আবার সাদা ময়দার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। কখনো কখনো এসব খাদ্যের লেবেলে ‘কমপ্লেক্স ফ্লাওয়ার’ বলা হয়। ভিটামিন বি বিশেষত টার্কি, টুনা এবং লিভারে বেশি থাকে। ভিটামিন বি–এর ভালো উৎসগুলোর মধ্যে আছে শিমজাতীয় (ডাল বা মটরশুঁটি), আস্ত শস্য, আলু, কলা, মরিচ ও গুড়।
ভিটামিন বি গ্রহণের জনপ্রিয় উপায় হলো ডায়েটরি খাবার ঠিকমতো খাওয়া। আমাদের দেশীয় উপায়ে মাঝেমধ্যে পান্তাভাত খাওয়া; কারণ এটা ভিটামিন বি–এর আধার, যা দ্রুত ঘাটতি পূরণে সহায়ক।
লেখক: খাদ্য ও পথ্যবিশেষজ্ঞ; প্রধান নির্বাহী, প্রাকৃতিক নিরাময় কেন্দ্র।
ছবি: চ্যাটজিপিটি