আমাদের এই ফুসফুসে নানা ধরনের সমস্যায় আধুনিক অনেক কার্যকর চিকিৎসার বিকল্প চিকিৎসা আকুপ্রেশার, নিয়মিত আকুপ্রেশার করে ফুসফুসের নানান সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় ওষুধ ছাড়াই। আকুপ্রেশারের সুবিধা হচ্ছে, এর পয়েন্ট জেনে নিজে নিজেই আকুপ্রেশার করা সম্ভব। আবার রোগ না হলেও নিয়মিত আকুপ্রেশার করে ফুসফুস সতেজ রাখা যায়। ফুসফুস–সংক্রান্ত আকুপ্রেশার করার নিয়ম দেওয়া হয়েছে।
ফুসফুসের সমস্যা: শ্বাসনালির প্রদাহ বা ব্রঙ্কাইটিস, কাশি, হুপিং কাশি, রক্তকাশি, স্বরভাঙা, হাঁপানি, ঘন ঘন নিশ্বাস নেওয়া, ডিফথেরিয়া, বুকে ব্যথা, পার্শ্ব ব্যথা ইত্যাদি সাধারণ সমস্যা ছাড়াও ফুসফুসে ক্যানসার হয়ে মানুষের মৃত্যুহার খুব একটা কম না।
অ্যাজমা: হাঁপানি বা অ্যাজমা একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ, যার মূল লক্ষণ হলো শ্বাসকষ্ট ও শাঁ শাঁ শব্দে নিশ্বাস ফেলা। মূলত এটা একটা বংশগত রোগ। অ্যালার্জি, তামাকের ধোঁয়া ও রাসায়নিক উত্তেজক পদার্থ হাঁপানির মূল কারণ হিসেবে ধরা হয়। অ্যাজমা বা হাঁপানি কারও একবার হলে পুরোপুরি নিরাময় হয় না, কিন্তু যথাযথ চিকিৎসাসহ নিয়ম মানলে রোগটি যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে এনে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব।
সিওপিডি: ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ বা সিওপিডি একধরনের ফুসফুসের রোগ, যা ফুসফুসে অক্সিজেন প্রবাহের গতি ধীর করে দেয়, ফলে শ্বাস নেওয়ায় সমস্যা দেখা দেয়। দেখা গেছে, এই রোগে আক্রান্ত ৪০ শতাংশ মানুষই মানসিক কষ্ট ও উদ্বেগের সমস্যায় ভোগেন।
শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ: শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ বলতে শ্বাসনালির সঙ্গে জড়িত নানা রোগকে বোঝায়। এ ধরনের সংক্রমণকে সাধারণত উচ্চতর শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণ বা নিম্ন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। উচ্চ শ্বসনতন্ত্রে সাধারণত সংক্রমণের মধ্যে টনসিলাইটিস, ফ্যারিনজাইটিস, ল্যারিনজাইটিস, সাইনোসাইটিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া, সর্দি ইত্যাদি অন্যতম।
যক্ষ্মা: বাংলাদেশে ফুসফুসের প্রধান রোগ যক্ষ্মা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের যক্ষ্মাবিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদন বলছে, যক্ষ্মা রোগের হার সবচেয়ে বেশি, এমন আক্রান্ত ছয়টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। এটি ছোঁয়াচে রোগ বলে যক্ষ্মায় আক্রান্ত একজন রোগী আরও ১০ জনকে আক্রান্ত করতে পারেন।
কোভিড–পরবর্তী উপসর্গ: কোভিড থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তিদের একটা বড় অংশের পালমোনারি ফাইব্রোসিস হয়। ফাইব্রোসিস হলে ফুসফুস শক্ত আকার ধারণ করে, তখনই অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের যাওয়া-আসা ব্যাহত হয়। এ কারণে ফুসফুসের থলিগুলো ফুলতে পারে না, ফলে রোগী দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্টে ভোগেন।
আকুপ্রেশার
আকুপ্রেশার শুরু করার প্রথম নিয়মটি হচ্ছে, দুই হাতে তালুতে ভালো করে ঘষুন। দুই মিনিট দুই হাতে তালু ঘষলে হাত দুটি গরম হয়ে যাবে। তারপর দুই হাতের ১০ আঙুলের ডগায় নখের ওপরে (ছবিতে দেওয়া আছে, ঠিক সেভাবেই) এক হাতে অন্য হাত দিয়ে চাপ দিতে হবে। প্রথমে ডান হাতে সব কটি আঙুলে আকুপ্রেশার করে বাম হাতের সব আঙুলে আকুপ্রেশার করবেন। প্রতিটি আঙুলে ৫০টি করে চাপ দেবেন।
তারপর হাতের তালুতে আঙুলের নিচের দিকে হাতের রেখার ওপরে পুরো জায়গাটায় (ছবিতে দেওয়া পয়েন্ট) কড়ে আঙুল থেকে ইনডেক্স ফিঙ্গার পর্যন্ত ধীরে ধীরে চাপ দেবেন, এতে কোনো একটা স্থানে ব্যথা অনুভূত হবে, যেখানে ব্যথা, সেখানেই বেশি চাপ দিতে হবে। এখানে ১০০টি করে চাপ হবে।
তারপর গলার পয়েন্টে আকুপ্রেশার করতে হবে। ছবিতে দেওয়া পয়েন্টে ওপর থেকে নিচের দিকে এখানে ১০০টি করে চাপ দিতে হবে। এই তিন পয়েন্টে আকুপ্রেশার করে পুনরায় দুই হাত দুই মিনিট ঘষুন।
প্রতিদিন দুইবার সকালে খালি পেটে এবং রাতে শোয়ার আগে আকুপ্রেশার করুন। নিয়মিত আকুপ্রেশার করলে এক মাসের মধ্যেই উপকার পেতে থাকবেন। সেই সঙ্গে যদি কিছু খাদ্যবিধি মানা যায়, তাহলে উপকার দ্বিগুণ হবে।
রোগ অনুযায়ী পথ্য
হলুদ: প্রতিদিন রাতে শোয়ার আগে এক কাপ কুসুম গরম পানিতে আধা চামচ হলুদের গুঁড়া মিশিয়ে খেলে শ্বাসযন্ত্রে বাতাস চলাচল–সংক্রান্ত জটিলতা দূর করে। হলুদে আছে কারকিউমিন, যা ফুসফুস প্রাকৃতিকভাবে পরিষ্কার করে এবং শরীর থেকে বিষাক্ত উপাদান দূর করে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
আদা: ঠান্ডা ও কাশির ঘরোয়া সমাধান এর প্রদাহরোধী উপাদান শ্বাসযন্ত্র থেকে বিষাক্ত উপাদান দূর করে। এতে রয়েছে ভিটামিন ও নানা রকম খনিজ, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, বিটা ক্যারোটিন ও জিঙ্ক। কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, আদা ফুসফুসের ক্যানসারের কোষ দূর করতে সাহায্য করতে পারে। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে মৌসুমি ঠান্ডা ও সংক্রমণ দূর করতে আদার চা বিশেষ উপকারী। সাধারণত আদা খাওয়ার পরে এক কাপ গরম পানিতে এক চামচ আদার রস মিশিয়ে খাওয়ার অভ্যাস করলে ফুসফুস তাজা থাকবে।
পুদিনার চা: গরম পুদিনার চা মিউকাস, প্রদাহ ও গলাব্যথা দূর করে। পুদিনার চা ফুসফুসের সংক্রমণ ও নিউমোনিয়ার কারণে জমে থাকা শ্লেষ্মা, প্রদাহ ও গলাব্যথা দূর করতে পারে। সারা দিনে দুইবার পুদিনার চা পান করতে পারেন।
শ্বাস হচ্ছে মানুষের আয়ুর কাউন্টডাউন, যা প্রতি নিয়তই কমছে, তাই কম শ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকাটাই প্রধান কাজ। আকুপ্রেশারে ফুসফুসের জটিল থেকে জটিল রোগ সেরে যায়। এই ক্ষেত্রে আকুপ্রেশার খাদ্য, পথ্য ছাড়াও শ্বাসের ব্যায়াম খুবই কার্যকর। বিশেষ করে যোগ ও প্রাণায়াম। ফুসফুস সতেজ রাখতে ধূমপান, ধোঁয়া, ধুলা থেকে দূরে থাকতে হবে, ঠান্ডা খাবার পরিত্যাগ করতে হবে।
লেখক: খাদ্য, পথ্য ও আকুপ্রেশার বিশেষজ্ঞ