ন্যাচারোপ্যাথি, মশলা

দারচিনি খাওয়ার নানা উপকারিতা

দারচিনি বা দারুচিনি (বৈজ্ঞানিক নাম:Cinnamomum verum) কণ্ঠশুদ্ধি করে। সুগন্ধ ও স্বাদ বৃদ্ধি করবার জন্যে গরম মশলায় দারচিনির ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে। দারচিনি যেমন মুখশুদ্ধি করে তেমনই কণ্ঠশুদ্ধিও করে। এটা খেলে মুখ সুবাসিতও হয়। শুধু মশলা বা মুখশুদ্ধি হিসেবেই নয় ঔষধি হিসেবেও দারচিনির উপযোগিতা অনেক।

দারচিনি সাধারণত দু ধরনের পাওয়া যায় মোটা ছাল ও পাতলা ছাল। মোটা ছালের দারচিনি আয়ুর্বেদের মতে লঘু, উষ্ণ, তীক্ষ্ণ, মধুর, কটু, রুক্ষ এবং পিওকারক। কফ, বায়ু, চুলকুনি, আমাশা ও অরুচি নাশ করে এবং হৃদরোগ, মূত্রাশয়ের অসুখ, অর্শ, কৃমি ও সর্দির উপশম করে কিন্তু বীর্য হরণ করে পাতলা ছালের দারচিনি। আয়ুর্বেদের মতে, মধুর, তেতো, তীক্ষ্ণ, সুগন্ধি, বীর্যবর্ধক, শরীরের বর্ণ উজ্জ্বল করে এবং বায়ু, পিত্ত, সাইনাস (মুখশোষ) এবং তৃঞ্চা উপশম করে।

আয়ুর্বেদের মতে, আরও বলা হয় দারচিনি উষ্ণবীর্য (কড়া), লঘুপাক (সহজে হজম হয়), রুক্ষ, পিওবর্ধক, শুক্রনাশক, অরুচি, কৃমি, মূত্রাশয়ের দোষনাশক, কণ্ড (চুলকুনি), অর্শ, আমবাত, কফ ও বায়ু উপশম করে। দারচিনির তেল উত্তেজক, সেই জন্যে দাঁতের ব্যথা, পেটের ব্যথা, জিভ আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া ইত্যাদি অসুখ ও অসুবিধের উপশম করে।

বৈজ্ঞানিক মতে, দারচিনি অত্যন্ত কার্যকর সুগন্ধি ঔষধি। উষ্ণ, দীপন (উদ্দীপিত করে), পাচন (খাবার হজম করায়), বাতহরণ করে, মলরোধ করে (স্তম্ভন), গভশিয়-উত্তেজক, গভাশয় সংকোচ, রক্তের শ্বেতকণিকা বৃদ্ধি করে এবং শরীরে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। জীবাণু নাশ করে, কালাজ্বর টাইফয়েড এবং অনেক সংক্রামক অসুখে উপশম করে। গা বমি করা, বমি, পেটের অসুখ সারিয়ে দেয়। দারচিনির তেলের দু তিন ফোঁটা এক কাপ জলে মিশিয়ে খেলে ইনফ্লুয়েঞ্জা, জিভ আটকে যাওয়া, পেটের অসুখ, আন্ত্রিকব্যথা, হেঁচকি, বমি ইত্যাদি অসুখে উপকার হয়। মূত্র বৃদ্ধি করে। আন্ত্রিক রোগ, কলেরা ইত্যাদি যে সব অসুখে অতিরিক্ত মল নিষ্কাশিত হওয়ার জন্যে প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায় সেই সব অসুখে উপকারী।

সুস্থ থাকতে দারচিনির প্রয়োগ:

১. সর্দি সারাতে: দারচিনি, গোলমরিচ এবং আদা একসঙ্গে মিহি করে পিষে জলে মিশিয়ে আঁচে বসিয়ে কাথ তৈরি করে খেলে সর্দি সেরে যায়। দারচিনি পিষে, গরম করে প্রলেপ লাগালে কিংবা দারচিনির তেল বা আরক লাগালে সর্দির জন্যে যে মাথা ব্যথা তার উপশম হয়।

২. বমি কমাতে: দারচিনির ক্বাথ পান করলে পিত্তের জন্যে যদি বমি হয় তা বন্ধ হবে।

৩. ঋতুস্রাবে সমস্যায়: মেয়েদের ঋতুস্রাব পরিষ্কার হয় এবং বাচ্চা হওয়ার পর গর্ভাশয় সংকুচিত হয়। দারচিনির তেল বা দারচিনির ক্বাথ মেয়েদের ঋতুস্রাবে কষ্ট হলে সেই কষ্ট বা অসুবিধে দূর করে।

৪. পেটের অসুখে: দারচিনি খেলে অজীর্ণ, বমি, পেটের ব্যথা ও গ্যাস কমে যায়। দারুচিনির তেল বা আরক খুব অল্প পরিমাণে খেলে পেটের ব্যথা কমে যায়।

৫. কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে: এক চা চামচ দারচিনি এবং তার চেয়ে কিছু বেশি পরিমাণে ছোট হরিতকী একসঙ্গে চূর্ণ করে (সব মিলিয়ে প্রায় দেড় চা চামচ) এক গ্লাস গরম জলে মিশিয়ে রাত্রিরে পান করলে সকাল বেলা মল পরিষ্কার হয় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য আর থাকে না।

৬. আমাশয় সারাতে: যতটা দারচিনি (অল্প পরিমাণে) তার দু-গুণ পরিমাণ বেলের শাঁস বা বেল শুঁঠ (পুরনো বেল) একসঙ্গে চূর্ণ করতে হবে। এই চুর্ণ গুড় আর টাটকা পাতা টক দইয়ে মিশিয়ে খেলে শুলযুক্ত আমাশা সেরে যায়। সব মিলিয়ে চূর্ণের পরিমাণ হবে প্রায় দেড় চা চামচ। দারচিনির গুড়া অর্ধ চামচ গরম জলে গুলে খেলে আমাশা সেরে যায়।

৭. পাতলা পায়খানা বন্ধ করতে: দারচিনি সাদা খয়েরের সমান সমান মাপের চূর্ণ অল্প পরিমাণে নিয়ে মধু মিশিয়ে খেলে বদহজমের জন্যে যদি বারবার পাতলা পায়খানা হয় তা বন্ধ হয়ে যাবে।

৮. বাতের ব্যথায়: বাতের ব্যথায় দারচিনির তেল মালিশ করলে সুফল পাওয়া যায় ।

৯. দাঁতের ব্যথায় উপশম পেতে: দারচিনির তেল বা আরক তুলায় নিয়ে যে দাঁতটা ব্যথা করছে তাতে লাগিয়ে রাখলে আরাম পাওয়া যায়।

১০. শরীরের দুর্বলতা কাটাতে: কলেরার জন্যে বা অন্য কোনো কারণে জ্ঞান হারালে এবং দুর্বলতার জন্যে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেলে দারচিনির তেল তিলের তেলের সঙ্গে মিশিয়ে মালিশ করলে শরীর গরম হয় আর চেতনা ফিরে আসে।

১১. ঘুম কাটাতে: দারচিনির মিহি চূর্ণ চোখ বন্ধ করে চোখের পাতায় লাগালে মূচ্ছা ও তন্দ্রা দূর হয়।

১২. হার্টের সমস্যা দূর করে: হার্টে উত্তেজনার সৃষ্টি করে, হার্টের পুষ্টিও করে, হার্টের দুর্বলতা নাশ করে অথাৎ হার্ট সবল করে তোলে, অনিদ্রা দূর করে ঘুম আনে।

কিন্তু ভাল জিনিসেরও অতি ব্যবহার ভাল নয়। দারচিনি বেশি পরিমাণে বেশি দিন ধরে খেলে তা বীর্যশোষণ করে নেয় অথাৎ বীর্যশোধক হয়ে দাঁড়ায় এবং নপুংসকতা দেখা দেয়। যাঁদের প্রকৃতি গরম তারা খুব সাবধানে দারচিনি খাবেন। দারুচিনির তেল তো বেশি পরিমাণে ব্যবহার করলে বিষতুল্য। এই তেল বা আরক অত্যন্ত উগ্র সেই জন্যে যাতে কোনো রকমেই চোখে না লেগে যায় সে বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে।

তথ্যসূত্রঃ

১. সাধনা মুখোপাধ্যায়: সুস্থ থাকতে খাওয়া দাওয়ায় শাকসবজি মশলাপাতি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, নতুন সংস্করণ ২০০৯-২০১০, ২৪৮-২৫০

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *